তুমি যখন আকাশের দিকে তাকাও, গভীর রাতে, তখন একটা জিনিস দেখতে পাও—তারা। ঝলমলে, স্থির, কিন্তু হঠাৎ কোনো একটা তারকা পড়ে যায়। আর তুমি বলে ওঠো: একটা তারা পতিত হলো!
আল্লাহ বলছেন:
“وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ”
"আমি শপথ করছি ঐ তারার, যখন তা পতিত হয়।" (সূরা আন-নাজম ৫৩:১)
তারার এই পতন শুধু একটা দৃশ্য না। এটা একটা আলামত। একটা ইঙ্গিত। তুমি তখন জানো, কিছু ঘটছে, কিছু পরিবর্তন আসছে। তারার পতন একটা নতুন সময়ের সূচনা।
আর এই আয়াতের পরপরই আসে:
“مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ
"তোমাদের সাথী পথভ্রষ্ট হয়নি, এবং সে ভ্রান্তও নয়।" (৫৩:২)
আল্লাহ যেন বলছেন, এই যে ব্যক্তি — যাকে তোমরা চেনো, যে তোমাদের মাঝে বড় হয়েছে, যার সততা, যার আমানতদারির গল্প তোমরা নিজেরাই করো — সে কিন্তু কোনো গাঁজাখুরি গল্প বলছে না। সে নিজের ইচ্ছায় কিছু বলছে না।
সে যা বলছে, তা গভীর কিছু। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু।
আর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী?
সে বলছে এমন এক দিনের কথা, যা সবকিছু বদলে দেবে। সে বলছে কিয়ামতের দিনের কথা। যে দিন তুমি কেবল আল্লাহর সাথেই দেখা করবে না, তুমি নিজের আমলের সাথেও দেখা করবে। সে দিনেই সবকিছু মুখোমুখি হবে—আল্লাহ, মানুষ, তাদের কাজ, ফেরেশতা, শয়তান—সব এক বিন্দুতে মিলিত হবে।
এই বার্তাটা এমন এক কথা, যা মানুষের জীবনযাত্রা নির্ধারণ করে দেবে।
এবং তুমি কুরআনের দিকে তাকাও, তখন বোঝো—এই পুরো সূরা আসলে শুরুই হয়েছে এক অলৌকিক সত্যের ঘোষণা দিয়ে। এক সততার ঘোষণা দিয়ে। রাসূল ﷺ কিছু নিজে থেকে বলছেন না।
আল্লাহ বলেন:
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ
"সে নিজের খেয়াল থেকে কিছু বলে না।" (৫৩:৩)
এটা তার নিজের অনুভূতি থেকে আসা কোনো কথা নয়। এটা তো আসলে ওহী —
“إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ
"এ তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহী করা হয়।" (৫৩:৪)
এখানে একটা শক্তিশালী সংযোগ তৈরি হয়। القسم ও جواب القسم — কসম এবং তার জবাব।
আল্লাহ শপথ করেছেন তারার। এবং তারপর বলেছেন, “তোমাদের সাথী বিভ্রান্ত নয়।” এই শপথ এবং বক্তব্যের মাঝে একটা গভীর সম্পর্ক আছে।
আচ্ছা, শব্দটা “النجم” — এর একটি অর্থ শুধু “তারকা” নয়, বরং এর মূল ধাতু نَجَمَ থেকে এসেছে, যার অর্থ — কিছু উপরে ওঠা বা ধাপে ধাপে বের হওয়া। এখান থেকে ইঙ্গিত আসে — কুরআনের খণ্ড খণ্ড অবতরণ।
তাহলে, আল্লাহ যখন বলছেন, “وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ”, তিনি আসলে কুরআনের অবতরণকেও বোঝাচ্ছেন।
এই কুরআন একসাথে নামেনি। ধাপে ধাপে নাজিল হয়েছে।
তোমরা যখন প্রশ্ন করো, আয়াত আসে:
“وَيَسْأَلُونَكَ … قُلْ …”
"তারা জিজ্ঞেস করে, বলুন…"
এমন প্রতিটি প্রশ্নের জবাব সময় মতো এসেছে।
এটাই প্রমাণ করে দেয় — রাসূল ﷺ কিছু বানাচ্ছেন না। তিনি কিছুই নিজে থেকে বলছেন না।
আল্লাহ বলেন:
“مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ”
“وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ”
“إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَىٰ”
“সে পথভ্রষ্ট নয়, ভ্রান্ত নয়। সে নিজের খেয়ালে কিছু বলে না। এ তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহী করা হয়।” (৫৩:২–৪)
তারা ভাবতো, “আচ্ছা, এই প্রশ্নের তো তার জানার কথা নয়!”
→ কিন্তু কুরআন ঠিক তখনই উত্তর এনে হাজির করত।
→ এটাই প্রমাণ—এটা বানানো নয়।
তাহলে তারার পতনের অর্থ কী? শুধু দৃশ্য নয়। ইতিহাসে তারা ছিল ঋতু পরিবর্তনের সংকেত।
Pleiades নামের তারা ছিল এমন এক তারা, যার ওঠানামার সঙ্গে ঋতু পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী হতো।
ইবরাহীম (আ.)-এর সুহুফ এসেছিল, চলে গেছে।
মূসা (আ.)-এর তাওরাত এসেছিল, চলে গেছে।
ঈসা (আ.)-এর ইঞ্জিল এসেছিল, চলে গেছে।
এইসব ছিল তারার মতো—আলোর কিছু আভা ছিল, কিন্তু সীমিত।
কিন্তু যখন সূর্য ওঠে, তখন আর তারার আলো টেকে না।
সূর্যের আলো হলো কুরআনের আলো।
এটা আর কোনো রাত নয়। এটা দিনের শুরু।
আর রাসূল ﷺ — তিনিই সেই আলো বহনকারী।
আগের গ্রন্থগুলোতেও আলোক ছিল। আল্লাহ বলেন:
“فِيهَا هُدًى وَنُورٌ”
"তাতে ছিল হিদায়াত ও নূর।" (সূরা আল-মায়িদা ৫:৪৪)
→ কিন্তু সেটা ছিল তারার আলো, রাতের মতো সীমিত।
আর কুরআনের আলো?
সূর্য যেমন চারপাশ উন্মুক্ত করে দেয়, সামনে কী আছে তা স্পষ্ট করে দেয়—কুরআনও ঠিক তেমনি বাস্তবতা উন্মোচন করে।
এবং রাসূল ﷺ?
তিনি তো নিজেই কুরআনে চিত্রিত হয়েছেন সূর্য হিসেবে:
“وَجَعَلْنَا سِرَاجًا وَهَّاجًا”
"আমি এক প্রজ্বলিত প্রদীপ বানিয়েছি।" (সূরা আন-নাবা ৭৮:১৩)
“وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُنِيرًا”
"আল্লাহর অনুমতিক্রমে আহ্বানকারী এবং দীপ্তিমান প্রদীপ।" (সূরা আল-আহযাব ৩৩:৪৬)
রাসূল ﷺ হলেন পথদ্রষ্টা, আলো বহনকারী, সূর্যের মত উজ্জ্বল নির্দেশনা।
তোমরা জানো তো, তারারা ছিল প্রাচীন আরবদের নেভিগেশন সিস্টেম। রাতে ভ্রমণে তারা তাদের একমাত্র দিকনির্দেশক ছিল। এখনো, আধুনিক জিপিএস, স্যাটেলাইট—সবই অনেকাংশে তারার গঠনের ভিত্তিতে কাজ করে।
প্রাচীন আরবে কেউ কেউ নেশায় থাকলেও সে ভাবত তারাকে ছাড়িয়ে গেছে!
এমন কটাক্ষও করত তারা—“তুমি কি মনে করো, তুমি তারার মতো ধনী?”
তারা এমনই ছিল— এটা ছিল একটা সাংস্কৃতিক ভিত্তি।
তারা জানত কোন তারা কোন সময়ে ওঠে।
ঠিক যেমন কুরআনের আয়াতগুলোও সঠিক সময়েই এসেছে।
তাইতো তারা প্রশ্ন করত:
“لَوْلَا نُزِّلَ هَٰذَا الْقُرْآنُ جُمْلَةً وَاحِدَةً”
"কেন এই কুরআন একবারে অবতীর্ণ হলো না?" (সূরা আল-ফুরকান ২৫:৩২)
কিন্তু তারা কি এমন প্রশ্ন তারাদের নিয়ে করে?
না! তারা তো ঠিক সময় মতো তারাদের ওঠার অপেক্ষা করে।
ঠিক তেমনি কুরআনের প্রতিটি আয়াতও সময় মতো এসেছে।
→ ঠিক তখনই যখন প্রয়োজন ছিল।
তবুও যখন ওহী কিছু সময় আসতো না, তারা মজা করত:
“কি হলো, আয়াত তো আসে না!”
“আর তখন আল্লাহ সান্ত্বনা দিতেন:
“مَا وَدَّعَكَ رَبُّكَ وَمَا قَلَىٰ”
“আপনার প্রতিপালক আপনাকে ত্যাগ করেননি, এবং তিনি আপনার প্রতি বিরূপও হননি।” (সূরা আদ-দুহা ৯৩:৩)
এই ওহীর ফাঁকগুলোও ছিল পরিকল্পিত।
এটা কোনো বানানো নাটক নয়।
তারাগুলোর একটা বিশেষ দিক ছিল—তারা শুধু দিকনির্দেশনা নয়, ধর্মীয় পৌত্তলিক বিশ্বাসেরও অংশ ছিল।
অনেক সভ্যতায় তারা ছিল দেবতা।
কেউ ভাবত, ফেরেশতারা তারার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে।
অনেকে ভাবত, এই তারারাই তো উপাস্য।
তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল তারা। মিশরের পিরামিড, মায়া সভ্যতার মন্দির—সবই এমনভাবে তৈরি, যেন বিশেষ কোনো তারা দেখা যায়।
তখন কুরআন এসে বলে:
“وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ”
শপথ তারার, যখন তা পতিত হয়।
পতিত!
তারা কেবল আলো নয়—এখন তাদের পতন আসছে।
শিরকভিত্তিক ধর্মবিশ্বাসগুলো এখন পতনের পথে।
এটাই সেই মুহূর্ত — যখন আল্লাহ কসম করছেন, এবং কসমের জবাবে বলছেন:
“مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ”
আর আমি এখনো তোমাদের সেই সবচেয়ে বিস্ময়কর পয়েন্টটা বলিনি।
ওটা আমি কাল বলবো।
তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
আমাকেও প্রস্তুত হতে হবে।
ওটাই হচ্ছে মূল পয়েন্ট —
القسم و جواب القسم
শপথ এবং তার জবাব, তাদের সম্পর্ক।