আজ
আমরা এমন একটি
মূলধাতু নিয়ে কথা
বলব যা আমাদের
পরিচয়ের
সাথে, আমাদের
অস্তিত্বের
সাথে মিশে
আছে।
তিনটি
অক্ষর ر (র), ب (বা), ب (বা)।
R-B-B।
এই
মূল থেকে যে
শব্দটি এসেছে, তা হলো رَبٌّ
(রব)।
আমরা
যখন রব
শব্দটি শুনি, তখন
আমাদের মাথায়
আসে প্রভু , মালিক ।
কিন্তু এর
অর্থ আরও অনেক
গভীর, আরও অনেক
সুন্দর। রব
মানে শুধু ‘প্রভু‘ বা ‘মালিক‘ নয়। এর
মূল অর্থ হলো
প্রতিপালন
করা, লালন-পালন
করে ধীরে ধীরে
বিকশিত করা।
কোনো জিনিসকে
একেবারে শুরু
থেকে বিভিন্ন
নতুন নতুন
পর্যায়
বা
পরিবর্তনের
মধ্য দিয়ে
নিয়ে
যাওয়া, যতক্ষণ
না সে তার
চূড়ান্ত
গন্তব্যে পৌঁছায়।
আরবিতে একটি কথা
আছে:
رَبَّ
وَلَدَہُ
رَبّاً
وَرَبَّبَہ (রব্বা ওয়ালাদাহু
রব্ বাও ওয়া রব্বাবাহ) এর
মানে হলো, "সে তার
সন্তানকে
লালন-পালন
করেছে, তার
দেখাশোনা
করেছে যতক্ষণ
না সে প্রাপ্তবয়স্ক
হয়েছে।"
ঠিক যেমন একজন
বাবা-মা করেন।
বিখ্যাত
সাহাবী
কবি হাসসান
বিন সাবিত
(রাঃ)-এর
একটি কবিতায়
কী সুন্দরভাবে
এই ধারণাটি
এসেছে! তিনি
যার প্রশংসা
করছেন, তার
সৌন্দর্য
বর্ণনা করতে গিয়ে
বলছেন, সে
"সমুদ্রের
গভীরে সযত্নে
প্রতিপালিত হওয়া
ধবধবে সাদা মুক্তোর চেয়েও
সুন্দর।"
ভাষাবিদ ইবনে ফারিস এই
মূলের কয়েকটি
মৌলিক অর্থ
বলেছেন।
- প্রথমটি
হলো কোনো
কিছুর যত্ন নেওয়া
এবং তাকে
সুন্দর করে
তোলা। اَلرَّبُّ
(আর-রব্বু), مَالِکٌ (মালিক), خَالِقٌ (খালিক) এই সব
শব্দের
মধ্যেই যত্ন নেওয়া
এবং উন্নত
করার একটা
ধারণা
রয়েছে।
- দ্বিতীয় অর্থ
হলো স্থির ও
অবিচল থাকা।
যেমন বলা হয়:
اَرَبَّتِ السَّحَابَۃُ بِہٰذِہٖ الْبَلْدَۃِ (আরব্বাতিস
সাহাবাতু
বিহাযিহিল
বালদাহ) এর
অর্থ, "মেঘ এই
শহরের উপর
স্থির হয়ে
ছিল বা অনবরত
বৃষ্টি
ঝরাচ্ছিল।"
দেখুন, এখানেও
একটা স্থিরতা, একটা ধারাবাহিকতার
ধারণা আছে।
যা
প্রতিপালনের
জন্য
অপরিহার্য।
- তৃতীয় অর্থ
হলো একটির
সাথে আরেকটিকে
যুক্ত করা।
এই
সবগুলো অর্থ মিলিয়েই
কোনো জিনিসকে
ক্রমাগত লালন
করা ও নিখুঁত
করে তোলার প্রক্রিয়াকে
বলা হয় ربوبیت (রুবুবিয়্যাত)।
রূপক
অর্থে, একটি শিশুকে
আদর করে থাপড়ে
ঘুম পাড়ানোকেও
বলা হয় رَبَّتِ
الَمْرَأَۃُ
صَبِیَّہَا (রব্বাতিল মার আতু সবিইয়্যাহা)
। কেন? কারণ একটি
শিশুর শান্তিময়
ঘুম তার বেড়ে
ওঠার সাথে
সরাসরি জড়িত।
এটাও এক ধরনের
প্রতিপালন।
কোনো
কিছুকে
সংশোধন করা
এবং তাকে মজবুত
করার জন্য বলা
হয় رَبَّ (রব্বা), یَرُبُّ (ইয়ারুব্বু), رَبّاً (রব্বান) । আবার কোনো
কিছুকে একত্রিত
করা এবং
ক্রমাগত
বৃদ্ধি করার
অর্থেও এটি
ব্যবহৃত হয়।
- رِبَابَۃٌ (রিবা-বা) হলো
সেই থলে
যেখানে
অনেকগুলো
তীর একসাথে রাখা
হয়।
- رَبَّ الدُّھْنَ (রব্বুদ দুহন)
মানে হলো, "সে তেলকে পরিশ্রুত
ও সুগন্ধিযুক্ত
করেছে।
যেহেতু
প্রতিপালনের
ফল হলো ইতিবাচক
বিকাশ, তাই اَلِرّبَّۃُ
(আর-রিব্বাহ)
বলতে সেই
গাছপালাকেও বোঝায় যা
শীতেও শুকিয়ে
যায় না, বরং চিরসবুজ
থাকে।
- اَلْمَرَبُّ (আল-মারাব্বু)
হলো সেই ভূমি
যা গাছপালা ও
সবুজে ভরা
থাকে।
- اَلرُّبَّۃُ (আর-রুব্বাহ)
মানে অনেক ঝোপঝাড়যুক্ত
গাছ, প্রায় দশ
হাজার লোকের
একটি বিশাল
দল, বা
বিলাসিতার
প্রাচুর্য।
আল-কাতীবা
লিখেছেন, একটি দলকে
رِبِّیٌّ (রিব্বিয়্যুন)
বলা হয়, যার
বহুবচন হলো رَبِّیُّوْنَ (রিব্বিয়্যূন)
(দেখুন, সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৬)।
- اَلرَّبَابَۃُ (আর-রাবাবাহ):
মেঘের স্তর, একটার উপর আরেকটা।
- اَلرِّبَبُ (আর-রিবাব):
মিষ্টি (পানযোগ্য)
পানি যা কোনো
স্থানে
প্রচুর
পরিমাণে জমা হয়েছে।
- اَلرِّبِیْبَۃُ (আর-রাবীবাহ):
চুক্তি বা
সন্ধি। এর
আরেক অর্থ
রাষ্ট্র, কারণ
একটি
রাষ্ট্রে এক
জাতি আরেক
জাতির সাথে মিশে
থাকে।
اَلرَّبِیْبَۃُ (আর-রাবীবাহ), যার
বহুবচন رَبَائِبُ (রাবা-ইব), বলতে সেই
কন্যাকেও বোঝায়
যে তার মায়ের
সাথে (নতুন
স্বামীর ঘরে)
আসে এবং সে
তার মায়ের
আগের স্বামীর
সন্তান। অথবা
সেই ছাগী, যাকে মাঠে
না চরিয়ে
ঘরে লালন-পালন
করা হয়
যাতে
প্রয়োজনের সময় তার
দুধ পাওয়া
যায়। {T}
উপরের
এতগুলো
উদাহরণ থেকে رَبٌّ
(রব)-এর অর্থ
এখন আমাদের
কাছে আরও
স্পষ্ট। যিনি
প্রতিপালন
করেন, যিনি
কোনো কিছুকে পরিপূর্ণতায়
নিয়ে
যান, যিনি সব গুছিয়ে
দেন, যিনি
উন্নতি সাধন
করেন। এজন্যই একটি
জাতির নেতাকে
বলা হয় رَبُّ
الْقَوْم (রব্বুল ক্বাওম) বা ‘জাতির প্রতিপালক‘ এবং
বাড়ির কর্তাকে
বলা হয় رَبُّ
الْبَیْتِ (রব্বুল
বাইত) বা ‘ঘরের প্রতিপালক‘। {T}
رَبَّ
الْقَوْمَ (রব্বাল ক্বাওম)
মানে হলো, "তিনি
রাষ্ট্রের দায়িত্বভার
গ্রহণ করেছেন
এবং জাতিকে
নেতৃত্ব দিয়েছেন।
‘মুনতাহিল আরব‘ গ্রন্থ
অনুযায়ী, رَبٌّ (রব)
বলতে বড়
ভাইকেও
বোঝানো হতে
পারে। বনী
ইসরাঈল
যখন মূসা
(আঃ)-কে বলেছিল:
৫:২৪ – فَاذْهَبْ
اَنْتَ
وَرَبُّکَ
فَقَاتِلَا
অর্থাৎ, "অতএব, তুমি এবং
তোমার রব (বড়
ভাই হারুন)
যাও এবং যুদ্ধ
করো।"
হতে
পারে, তারা এখানে বিদ্রূপও
করছিল।
আর এই ‘রব‘ থেকেই এসেছে اَلرَّبَّانِیُّ
(আর-রব্বানী)।
কারা এই রব্বানী? সেই
ব্যক্তি যিনি আল্লাহর
সাথে
সম্পর্কিত।
অথবা সেই
শিক্ষক, যিনি তাঁর
ছাত্রদের
মনকে প্রথমে
জ্ঞানের ছোট ছোট ডোজ দিয়ে
গড়ে তোলেন, তারপর বড়
জ্ঞানের দিকে নিয়ে
যান। অর্থাৎ, যিনি
জ্ঞান দিয়ে
মানুষের
আত্মার
প্রতিপালন
করেন।
প্রত্যেক আলেম
এবং সঠিক
জ্ঞানের অধিকারীকে
رَبَّانِیٌّ (রব্বানী)
বলা হয়।
এবার
এই সবকিছু
মাথায় নিয়ে, আসুন আমরা
কুরআনের
সূচনার দিকে
তাকাই।
১:২ – اَلْحَمْدُ
لِلّٰهِ
رَبِّ
الْعَالَمِیْنَ
অর্থাৎ, "সকল প্রশংসা আল্লাহর
জন্য, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের
রব বা প্রতিপালক।"
এই মহাবিশ্বের
প্রতিটি
জিনিস
সাক্ষ্য
দিচ্ছে যে এর
পেছনে এক মহা পরিকল্পনা
কাজ করছে। এই
পরিকল্পনায়
একটি বীজ, প্রতিপালনের
বিভিন্ন পর্যায়
অতিক্রম করে, একটি
পূর্ণাঙ্গ
ফলে পরিণত হয়।
এটাই হলো আল্লাহর
প্রতিপালন
ব্যবস্থা। আর আল্লাহ
প্রশংসার
যোগ্য, কারণ তিনিই সবকিছুকে
এভাবে
লালন-পালন
করছেন।
আল্লাহর এই
প্রতিপালন
ব্যবস্থা বা ‘নিযামে রুবুবিয়্যাত‘ যেমন
প্রকৃতির
জগতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে
কাজ করছে, ঠিক তেমনি
মানুষের
সামাজিক
জীবনেও এই
ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা
করার কথা বলা হয়েছে।
কীভাবে? উপায় হলো, জীবিকার উৎস এবং
মানুষের সক্ষমতাকে
সকলের জন্য
উন্মুক্ত করে দেওয়া।
যাতে মানবজাতির
সকল সুপ্ত
প্রতিভা
বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণতায়
পৌঁছাতে
পারে। যারা
এমন ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা
করবে, তাদেরকেই
বলা হবে ‘রব্বানিয়্যূন‘ (৩:৭৯), আর এই
ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা
করা যায় কুরআনের
বিধান অনুসরণ
করে।
এটাই কুরআনের
সকল শিক্ষার
মূল নির্যাস। অর্থাৎ, আল্লাহর
প্রতিপালন
ব্যবস্থার
প্রতিষ্ঠা।
যেহেতু এর
সাথে মানুষের
শারীরিক
অস্তিত্ব এবং
তার ব্যক্তিত্ব
উভয়ই জড়িত, তাই একটি
ইসলামী
রাষ্ট্রের
দায়িত্ব হলো
এমন একটি
ব্যবস্থা
প্রতিষ্ঠা
করা যা কেবল
প্রত্যেক
ব্যক্তির
প্রয়োজনই
মেটাবে না, বরং তার সক্ষমতা
বিকাশের
জন্যও সমান
সুযোগ তৈরি
করবে। যখন একজন
মানুষের
ব্যক্তিত্ব
এভাবে
প্রতিপালিত হয়, তখন মৃত্যুও
আর কোনো
পার্থক্য
গড়ে দেয় না।
কারণ জীবন তখন
পরবর্তী ধাপে, অর্থাৎ আখিরাতের
দিকে এগিয়ে
যায়। আর আল্লাহর
প্রতিপালন
সেখানেও চলতে
থাকে।
সার্বজনীন
প্রতিপালনই
হলো একটি
ইসলামী
সমাজের
উদ্দেশ্য। অর্থাৎ,
জাতি,
বর্ণ,
গোত্র,
ধর্ম
নির্বিশেষে
সকল মানুষের
প্রতিপালন। যতক্ষণ
পর্যন্ত একটি
মানব সমাজে এই
প্রতিপালন
ব্যবস্থার
প্রতিফলন না
ঘটবে, ততক্ষণ
তাকে ইসলামী
সমাজ বলা যাবে
না। এটাই কুরআনের
শিক্ষার
সূচনা।
যার
মধ্যে এই ‘রুবুবিয়্যাত‘-এর গুণ
প্রতিফলিত হয়, সে তার সমস্ত
শক্তি দিয়ে
উপার্জন করে।
আর তার
উপার্জনের যে
অংশ তার প্রয়োজনের
অতিরিক্ত, তা সে এই
ব্যবস্থার কেন্দ্রীয়
কর্তৃপক্ষের
কাছে (একটি
কল্যাণ
রাষ্ট্রে) জমা
দেয় অন্যদের
প্রতিপালনের
জন্য। এজন্যই
এমন সমাজে
সম্পদ জমানো
বা অট্টালিকা
বানানোর কোনো
ধারণা জন্মায়
না। এমন ব্যবস্থায়
কেউ জীবিকার উৎসের উপর
আধিপত্য
বিস্তারের
চেষ্টা করে না, কেউ
অন্যের
শ্রমের ফলও কেড়ে নেয়
না।
কুরআন ঠিক এই
ধরনের একটি
সমাজই গড়তে
চায়। আর
কেবল এমন একটি
ব্যবস্থাই
বিশ্বকে
দেখাতে পারে
যে, আল্লাহর বিধান
কতটা
প্রশংসার
যোগ্য। আর
এটাই হলো اَلْحَمْدُ
لِلّٰهِ
رَبِّ
الْعَالَمِیْنَ (আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল ‘আলামীন)-এর
বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
সকল প্রশংসা আল্লাহর
জন্য শুধু
মুখে নয়, কাজে, সমাজে, রাষ্ট্রে।