হা মীম দাল ( ح م د)

Spread the love

 

 

আজ আমরা আরবি ভাষার এক অসাধারণ মূলধাতু নিয়ে কথা বলব। তিনটি অক্ষর ح (হা), م (মীম), আর د (দাল)। এই তিনটি অক্ষর থেকে যে শব্দটি আমাদের সবার কাছে সবচেয়ে পরিচিত, তা হলো حَمْدٌ (হামদ)।

আমরা যখন হামদ শব্দটি শুনি, আমাদের মাথায় আসে প্রশংসা । কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। এটা শুধু মুখের কথা নয়। চলুন, আজ এর গভীরে ডুব দেওয়া যাক।

হামদ আসলে কী? লেখক মুহীত-এর বর্ণনানুযায়ী, এটি হলো সেই অনুভূতি যা একজন মানুষের হৃদয়ে তৈরি হয় যখন সে অত্যন্ত বিরল এবং মনোরম কোনো দৃশ্য বা জিনিস দেখে। ধরুন, আপনি এমন এক সূর্যোদয় দেখলেন যা আপনার জীবনের দেখা সেরা সূর্যোদয়। আপনার ভেতর থেকে যে একটা সুবহানাল্লাহ বা ওয়াও বেরিয়ে আসে, সেই অনুভূতির নামই হলো حمد (হামদ)। এটা শুধু ওই সুন্দর জিনিসটির প্রশংসা নয়, বরং ওই সৌন্দর্যের স্রষ্টার প্রতি এক গভীর কৃতজ্ঞতা এবং স্বীকৃতি।

তবে এই حمد (হামদ)-এর জন্য কিছু শর্ত আছে। এই শর্তগুলো পূরণ না হলে তাকে আর হামদ বলা যায় না।

প্রথম শর্ত হলো, যে জিনিসটির প্রশংসা করা হচ্ছে, তা হতে হবে বাস্তব এবং স্পর্শযোগ্য। এমন কিছু যা আমরা অনুভব করতে পারি, চোখে দেখতে পারি। যা কেবল ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ, তার জন্য حمد (হামদ) হয় না। যেমন ধরুন, কুরআনে مقام محمود (মাকামে মাহমুদ) বা প্রশংসিত স্থানের কথা বলা হয়েছে, বা صفات محمود (সিফাতে মাহমুদ) অর্থাপ্রশংসনীয় গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে। এগুলো ধারণাগতভাবে সুন্দর, কিন্তু حمد (হামদ) হয় তখন, যখন এই ধারণাগুলো বাস্তবে রূপ নেয়

একটু ভাবুন তো, আমরা একজন শিল্পীর প্রশংসা কীভাবে করি? তার কনসেপ্ট বা ভাবনা শুনে? না। আমরা তার আঁকা ছবিটা দেখে, তার বানানো ভাস্কর্যটা হাতে নিয়ে তার প্রশংসা করি। ঠিক এই কারণেই আল্লাহ কুরআনে সেইসব লোকদের তিরস্কার করেছেন, যারা নিজেরা কোনো গঠনমূলক কাজ না করেই প্রশংসার আশা করে। আল্লাহ বলছেন:

৩:১৮৭ – یُحِبُّوْنَ اَنْ یُحْمَدُوْا بِمَالَمْ یَفْعَلُوْا
অর্থা, "তারা এমন কাজের জন্য প্রশংসিত হতে ভালোবাসে যা তারা করেনি।"

দেখুন, কী গভীর একটি বার্তা! حمد (হামদ) কর্মের সাথে জড়িত, ফাঁকা বুলি বা ইচ্ছার সাথে নয়।

দ্বিতীয় শর্ত, এই প্রশংসাটা হতে হবে একদম মন থেকে, স্বেচ্ছায়। এখানে কোনো জোর-জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা থাকবে না। যখন একজন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করে, তখন তার নিজের মহত্ত্বও প্রকাশ পায়। যে কাজ এমনিতেই হয় বা যা জন্মগতভাবে অর্জিত, তার জন্য حمد (হামদ) ব্যবহার হয় না।

যেমন ধরুন, একটি মেশিনের কথা। যদি একটি মেশিন খুব সুন্দর জিনিস তৈরি করে, তাহলে ওই মেশিনটি حمد (হামদ)-এর যোগ্য নয়। তার জন্য مَدَحَ (মাদাহ) শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে, যার অর্থ সাধারণ প্রশংসা বা স্তুতি। কিন্তু ওই মেশিনের যিনি নির্মাতা, যিনি নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে ওটা বানিয়েছেন, তিনি حمد (হামদ)-এর যোগ্য।

 

 

আরেকটা সুন্দর উদাহরণ হলো ময়ূরের নাচ। আমরা বলি, مَدَحَ الْجَمَالَ (মাদাহ-আল জামাল) অর্থা, সৌন্দর্যের প্রশংসা। ময়ূরের নাচ নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু সেটার জন্য ময়ূর مَدَحَ (মাদাহ) বা স্তুতি পেতে পারে। কিন্তু আসল حمد (হামদ) বা গভীর প্রশংসা কার প্রাপ্য? সেই মহান স্রষ্টার, যিনি এমন সুন্দর একটি সৃষ্টিকে তৈরি করেছেন।

তৃতীয় শর্ত হলো, সত্যিকারের حمد (হামদ)-এর জন্য এটা জরুরি যে, প্রশংসিত জিনিসটি প্রশংসাকারীর নিজেরও পছন্দের হতে হবে। তার হৃদয়ের কাছাকাছি হতে হবে। কোনো চাপে পড়ে বা কাউকে খুশি করার জন্য যে প্রশংসা, তা حمد (হামদ) নয়, তা হলো مَدَحَ (মাদাহ)। হামদ -এর মধ্যে কোনো ছলনা, ভান, ভণ্ডামি বা তোষামোদীর স্থান নেই। এটা এমন এক অনুভূতি যা নিজের অজান্তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে।

চতুর্থ শর্ত, যে জিনিসটির প্রশংসা করা হচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য হতে হবে। কোনো অস্পষ্ট ধারণা, সন্দেহ বা দ্বিধার উপর ভিত্তি করে حمد (হামদ) হয় না। হামদ কোনো প্রতারণা, কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস থেকে জন্মায় না। এর ভিত্তি হলো দৃঢ় বিশ্বাস এবং আস্থা। অন্যদিকে, مَدَحَ (মাদাহ) বা সাধারণ প্রশংসা মতামতের ভিত্তিতেও হতে পারে, কিন্তু حمد (হামদ) নয়।

এবং পঞ্চম শর্ত হলো, যে উপকারী, আনন্দদায়ক এবং ভারসাম্যপূর্ণ সুন্দর জিনিসটির প্রশংসা করা হচ্ছে, তা অবশ্যই পরিপূর্ণতায় পৌঁছাতে হবে এবং তার উপকারিতা অনুভূত ও স্বীকৃত হতে হবে। যে জিনিস মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়, বা যে শিল্পকর্ম এখনো অপূর্ণ, তার জন্য حمد (হামদ) করা যায় না। যেমন ধরুন, একজন পকেটমারের হাতসাফাই হয়তো নিখুঁত, কিন্তু আমরা কি সেটার জন্য حمد (হামদ) করি? না। কারণ এটা মানুষের জন্য উপকারী নয়, বরং ক্ষতিকর।

এই পাঁচটি শর্তের একটিও যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে সেটাকে مَدَحَ (মাদাহ) বলা হবে, حمد (হামদ) নয়। এখানে আরেকটি শব্দ জেনে রাখা ভালো, ثناء (সানা), এই শব্দটি প্রশংসা এবং নিন্দা উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতে পারে।

আর تسبیح (তাসবীহ) মানে কী? এর অর্থ হলো, কোনো কিছু তার উপর অর্পিত দায়িত্বে পূর্ণ মনোযোগের সাথে ব্যস্ত থাকা।

এখন এই ধারণাগুলো নিয়ে কুরআনের দিকে তাকাই। দেখুন আল্লাহ কী বলছেন:

১৩:১৩ – وَیُسَبِّخُ الرَّعَدُ بِحَمْدِہٖ
অর্থা, "বজ্রও তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।"
এখানে বজ্র তার দায়িত্ব পালন করছে (তাসবীহ) এবং একই সাথে আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে তাঁর حمد (হামদ) করছে।

৩০:১৮ – وَلَهُ الْحَمْدَفِیْ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ
অর্থা, "এবং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে সকল প্রশংসা তো তাঁরই।"
এই মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি সৃষ্টিতে কেবল তাঁরই حمد (হামদ)।

১৭:৪৪ – وَاِنْ مِّنْ شَیْءٍ اِلَّا یُسَبِیْحُ بِحَمْدِہٖ
অর্থা, "এমন কোনো জিনিস নেই যা তাঁর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না।"

এর মানে কী দাঁড়ালো? এর মানে হলো, এই মহাবিশ্বের কোনো কিছুই আল্লাহর আইন মেনে চলা থেকে বিরত থাকতে পারে না এবং একই সাথে তারা আল্লাহর حمد (হামদ) বা প্রশংসা পরিচালনা করছে। প্রতিটি সৃষ্টি তার অস্তিত্ব ও কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর সৃজনশীলতার জীবন্ত উদাহরণ হয়ে আছে, আর এটাই হলো আল্লাহর প্রশংসা। ব্যাপারটা এতই গভীর যে, যখন কোনো ধ্বংসাত্মক শক্তিকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই কাজটিও প্রশংসার যোগ্য হয়ে ওঠে।

যেমন, অত্যাচারী জাতির ধ্বংসের পর বলা হয়েছে:

৬:৪৫ – فَقُطِعَ دَابِرُ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ
অর্থা, "অতঃপর যালিম সম্প্রদায়ের মূলোৎপাটন করা হলো এবং সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের রব।"
এখানে অকল্যাণকে দূর করাটাও এক প্রকার حمد (হামদ)-এর উপলক্ষ।

এজন্যই আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে তিনি عَزِیْزٌ (আযীয) এবং حَمِیْدٌ (হামীদ)। অর্থাৎ তিনি যেমন পরাক্রমশালী (আযীয), তেমনই প্রশংসিত (হামীদ)। তিনি ধ্বংসাত্মক শক্তিকে অপসারণ করেন, যাতে কল্যাণকর দিকগুলো প্রকাশিত হতে পারে এবং আল্লাহর حمد (হামদ)-এর জীবন্ত নজির হয়ে উঠতে পারে।

আরেক জায়গায় বলা হয়েছে:

৬৪:১ – لَهُ الْمُلْکُ وَلَهُ الْحَمْدُ
অর্থা, "কর্তৃত্ব তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই।"
তিনিই সকল মহিমা ও সৌন্দর্যের উৎস

আর মুমিনদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা حَامِدُوْنَ (হামিদূন), যেমনটি সূরা আত-তাওবার ১১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে। এর মানে হলো, তারা আল্লাহর حمد (হামদ) করে। আর এই حمد (হামদ) করার জন্যই মানুষকে দেওয়া হয়েছে সকল নামের জ্ঞান‘, অর্থাৎ প্রকৃতির উপাদানগুলোর জ্ঞান। কারণ ফেরেশতারা যখন বলেছিলেন:

২:৩০ – وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِکَ
অর্থা, "আর আমরা তো আপনার সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করি।"

তখন আল্লাহ জবাবে আদমকে (মানুষকে) যা দিয়েছিলেন তা হলো:

২:৩১ – وَعَلَّمَ آدَمَ الْاَسْمَاءَ کُلَّهَا
অর্থা, "এবং তিনি আদমকে সকল নাম শিক্ষা দিলেন।"
এই জ্ঞানই মানুষকে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের গভীরে প্রবেশ করে সত্যিকারের حمد (হামদ) করার যোগ্যতা দেয়। কিন্তু এই জ্ঞান তখনই কার্যকর হবে, যখন তা আল্লাহর ওহী বা ঐশী বার্তার অধীনে থাকবে।

এজন্যই মানুষকে বলা হয়েছিল:

২:৩৮ – فَمَنْ تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَلَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ
অর্থা, "অতঃপর যারা আমার হেদায়েত অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।"

আর এটাই হলো সেই مَقَاماً مَحْمُوْداً (মাকামাম মাহমুদা) বা প্রশংসিত স্থান (১৭:৭৯)। এমন এক অবস্থান যা সম্পূর্ণরূপে حمد (হামদ) বা প্রশংসার যোগ্য। আর এই مقام আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) অর্জন করেছিলেন।

তাঁর নিজের নামই তো ছিল اَحْمَدُ (আহমাদ) (৬১:৬), যার একটি অর্থ হলো যিনি অত্যাধিক حمد (হামদ) বা প্রশংসা করেন (আল্লাহর)। আবার কেউ কেউ বলেন, এর অর্থ হলো যিনি নিজে অত্যাধিক প্রশংসিত। আর এই নামটিই পরে হয়েছে مُحَمَّدٌ (মুহাম্মদ) (৪৮:২৯), যার অর্থ এমন একজন যাকে ক্রমাগত প্রশংসা করা হয়, অর্থাৎ যার একটি গুণের পর আরেকটি গুণের প্রশংসা চলতেই থাকে। কিতাবুল আশকাকনামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদমানে যাকে বারবার প্রশংসা করা হয়, আর মাহমুদমানে যাকে একবার প্রশংসা করা হয়আকরাবুল মুওয়ারিদগ্রন্থ বলছে, ‘মুহাম্মদমানে যার মধ্যে বহু প্রশংসনীয় গুণাবলী রয়েছে।

এখন, এই পুরো আলোচনার আলোকে, যখন আমরা কুরআনের প্রথম আয়াতটি পড়ি:

১:২ – اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِیْنَ
অর্থা, "সকল حمد (প্রশংসা) আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের রব।"

তখন এর অর্থ কতটা গভীর হয়ে যায়, ভেবে দেখুন। কুরআন আমাদের সামনে এক মহাজাগতিক সত্য তুলে ধরেছে। এই মহাবিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি, প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর حمد (হামদ) বা প্রশংসার এক একটি উপলক্ষ। সেই আল্লাহর, যিনি সবকিছুকে তার প্রাথমিক পর্যায় থেকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে লালন-পালন করছেন।

সুতরাং, حمد (হামদ) কেবল একটি আবেগ বা মৌখিক বিষয় নয়, এটি একটি জীবন্ত সত্য যা মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে গভীর চিন্তার মাধ্যমে অর্জিত হয়। যে জাতি আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না, সে কীভাবে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করবে? আর কীভাবে বুঝবে যে এই মহাবিশ্বের সবকিছুই প্রশংসার যোগ্য?

আল্লাহর প্রশংসা করা মানে শুধু মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলা নয়, এটি একটি বাস্তব কর্মসূচি। আল্লাহর প্রশংসা করার অর্থ হলো, সমাজে এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যা আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন (এবং যা আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়েছেন)। এমন একটি ব্যবস্থা, যা এত অলৌকিক ও সুন্দর ফলাফল বয়ে আনবে যে, গোটা বিশ্ব তা দেখে চিনতে পারবে এবং প্রশংসা করে বলে উঠবে "নিঃসন্দেহে, যে আল্লাহ এমন বিধান দিয়েছেন, যা অনুসরণ করে এত সুন্দর ফলাফল পাওয়া যায়, তিনি সত্যিই অসীম প্রশংসার যোগ্য।"

এটাই হলো সত্যিকারের حمد (হামদ)। একটি জীবন্ত, বাস্তব এবং কর্মময় প্রশংসা।