সুরা আন নাজম (পর্বঃ০১)

Spread the love

প্রথমেই আমি EPIC-এ এই প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। আমি এই শুরুতে কয়েক মিনিট সময় নিয়ে আপনাদেরকে এই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চাই এবং ইনশাআল্লাহ সরাসরি মূল আলোচনায় প্রবেশ করব, কারণ আমাদের হাতে তেমন বেশি সময় নেই, যদিও তা হয়তো অনেক মনে হতে পারে।

এই প্রোগ্রামের মূল উদ্দেশ্য কুরআন সপ্তাহ। এটা নিয়ে আমি সারা বিশ্বে ভ্রমণ করছি। প্রত্যেক জায়গায় একটি করে সূরার ওপর আলোচনা করছি। এর পেছনে যে লক্ষ্য, তা খুবই স্পষ্ট: মুসলিমদেরকে কুরআনের প্রতি গভীর চিন্তা ও উপলব্ধির দিকে টেনে আনা। আমরা সবাই জানি, কুরআনের উপর তাদাব্বুর অর্থাৎ গভীর চিন্তা করা উচিত, সেটাকে বুঝে নেওয়া উচিত। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের বেশিরভাগেরই জানা নেই এই চিন্তার যাত্রা শুরু কোথা থেকে হয়। আমরা কীভাবে এই কুরআনের সঙ্গে একটি গভীর, ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারি?

এটা খুব সাধারণ দৃশ্য আমরা কুরআনের অনুবাদ পড়ি, একটা আয়াত বুঝতে পারি না, এড়িয়ে যাই। ভাবি, এই অংশটা না বুঝে ফেলি, অন্যটা পড়ি। এইভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এই প্রোগ্রামের উদ্দেশ্য হলো সেই ফাঁকগুলো পূরণ করা, যাতে করে আমিসহ প্রত্যেকে আল্লাহর বাণীর সৌন্দর্য ও গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি।

এখন আমি এই ৩০ মিনিটের সেশন শুরু করবো। যেন কেউ বিভ্রান্ত না হন প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭:৩০-এ আমি আলোচনা শুরু করব। এখানে ইশার সালাত ৮টায়, সুতরাং আমার কাছে ৩০ মিনিট সময় থাকে। আমি চাই, এই সময়টা পুরোপুরি কাজে লাগাতে। কেউ দেরি করলে করুক, আমি ঠিক সময় মতো শুরু করব ৭:৩০। এমনকি আমি সম্ভবত ৭টার আগেই এখানে থাকব। যদি কারো কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে ৭টার আগে এসে করতে পারেন। আমি প্রস্তুত থাকব। একবার আমি এখানে এসে গেছি মানেই, ইনশাআল্লাহ, আমি আপনাদের সেবায় সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত।

৭:৩০ থেকে ৮টা আমাদের প্রথম সেশন, তারপর ইশা, তারপর আবার ৮:১৫-এ ফিরে আসব। তখন হবে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের একটি দীর্ঘ সেশন। যদি আমি খুব নিষ্ঠুর হয়ে যাই, সেটা হতে পারে এক ঘণ্টার। এরপর বিরতি থাকবে চা-কফির জন্য যুদ্ধ করার সময়। বিরতি হবে ৫ থেকে ৭ মিনিটের, তার বেশি নয়। তারপর আমরা যাব শেষ সেশনে।

এই পুরো সপ্তাহের পরিকল্পনা এমন। আমাদের দুটি বড় লক্ষ্য প্রথমত, সূরা আন-নাজম (সূরা নম্বর ৫৩) নিয়ে ইনশাআল্লাহ গভীরভাবে চিন্তা করা। দ্বিতীয়ত, একটি থিমেটিক টুলসেট যেটা আমি ও শাইখ সোহাইব সাঈদ একত্রে তৈরি করেছি, সেটার মাধ্যমে কুরআনের ওপর চিন্তার পাঁচটি দৃষ্টিভঙ্গি (lenses) শেখা। যেন যখন আমরা কুরআন পড়ি, তখন চিন্তা করি আমি কী দৃষ্টিকোণ থেকে এই আয়াতটি দেখছি?

আসুন, এখন আসি আমাদের মূল আলোচনায়। আমি কিছু ব্যাখ্যা করতে চাই তাদাব্বুর মানে কী? গভীরভাবে চিন্তা করা বলতে কী বোঝায়? কুরআনে আল্লাহ কখনো বলেননি, তোমরা যদি সময় পাও, তখন কুরআনের উপর চিন্তা করো। এটা কোনো ঐচ্ছিক কাজ নয়। ঠিক যেমন নামাজ ফরজ, হারাম জিনিস হারাম তেমনি কুরআনের উপর গভীর চিন্তা করাও অপরিহার্য দায়িত্ব।

আল্লাহ কুরআনে দু বার জিজ্ঞেস করেছেন
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ
তারা কি কুরআনের উপর চিন্তা করে না?

এবং তিনি বলেন:
كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ
এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন তারা এর আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তা করে।

এখন এই দুঃখজনক বাস্তবতা, যে আমরা বহু শতাব্দী ধরে কুরআনকে একটি নির্দিষ্টভাবে শিখে যাচ্ছি। কেউ যখন বলে, আমি কুরআন শিখছি তা মানে সাধারণত কুরআন মুখস্থ করছে, তাজউইদ শিখছে, উচ্চারণ ঠিক করছে। কিন্তু প্রথম যুগে কুরআন শেখার মানে ছিল কুরআনের আয়াত বোঝা, তার উপর চিন্তা করা, আল্লাহ কী বলছেন তা উপলব্ধি করা।

আমি এখন দুটো শব্দ পরিষ্কার করতে চাই তাফসীর ও তাদাব্বুর।

তাফসীর হলো: এই আয়াতটি আমি ঠিকঠাক বুঝছি কিনা? এই শব্দগুলো কী বোঝাচ্ছে? কবে নাযিল হয়েছে? অনুবাদ ঠিক আছে তো? সাহাবারা কী বলেছিলেন? নবী কী বলেছেন? প্রেক্ষাপট কী ছিল? এই সব তথ্য সবই তাফসীর।

তাফসীরের অনেক শাখা আছে আত-তাফসীর বিল মা সুর, আত-তাফসীর আল-লুগাওয়ী, সাহিত্যের, আধ্যাত্মিক ইত্যাদি। আলেমগণ এই নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী কাজ করেছেন। কিন্তু লক্ষ্য একটাই এই আয়াতের অর্থ সাধারণ মানুষের বোধগম্য করা।

আর তাদাব্বুর?
তাদাব্বুর হলো ঠিক আছে, আমি বুঝে গেছি আয়াতটি কী বলছে। এখন এটা আমার জীবনে কী করছে?
তাফসীর তথ্য দেয়, আর তাদাব্বুর হলো সেই তথ্যের হৃদয়গ্রাহী প্রভাব। এটি আমাকে নাড়া দেয় কিনা? আমার চিন্তা বদলায় কিনা? আমার ভেতর বিশ্বাসের কোনো আলো জ্বলে উঠছে কিনা?

কিন্তু এখানে এসেছে একটা বড় সমস্যা তাফসীর জানলেই অনেকে ভাবে, তাদের আর তাদাব্বুর দরকার নেই। আবার কেউ কেউ বলে, আমি তাদাব্বুর করব, তাফসীরের দরকার নেই তারা শুধু অনুবাদ পড়ে ভাবতে চায়। কিন্তু তাফসীর ছাড়া তাদাব্বুর করলে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে।

এখানেই আমি একটা বাস্তব উদাহরণ দেই আমেরিকান খ্রিষ্টান প্রচারক জোয়েল অস্টিন। তিনি বাইবেল থেকে পড়েন, And the Lord said, there shall be dew. তারপর বললেন, তোমার জীবনেও এই বছর শিশির বর্ষিত হবে! মানে চাকরি হবে, বিয়ে হবে, সমস্যা মিটে যাবে। লোকেরা বলে Yes! My year of dew! কিন্তু এই কথার কোনো ভিত্তি নেই এটা একেবারে নিজের তৈরি তাদাব্বুর। কোনো তাফসীর নেই।

আবার অনেকে শুধুই তাফসীর পড়ে, হারিয়ে যায় তথ্যের জগতে আব্বাস বলেছেন, কুরতুবি বলেছেন, তাবারী বলেছেন... কিন্তু হৃদয়ে কোনো প্রভাব পড়ে না।

আমরা যারা শিক্ষার্থী, আমরা একটি ভারসাম্য তৈরি করি তাফসীরের ভিত্তিতে শুরু করি, তারপর প্রবেশ করি তাদাব্বুরে। প্রশ্ন করি এই আয়াত আমার জীবনে কী বলছে? এই সিরিজেও তুমি সেই ভারসাম্য দেখতে পাবে।

আমরা আজ যে সূরার মধ্যে যাচ্ছি সূরা আন-নাজম, এটা একটি মাক্কী সূরা। এখন তুমি বলতেই পারো সব মাক্কী সূরাতেই তো আল্লাহ, সৃষ্টি, কিয়ামত, পুরনো জাতিগুলো, জান্নাত-জাহান্নামের কথা বলা হয়। সব একই তো?

তাফসীরকারীরা বলেন, এই আয়াত তো আমরা আগের সূরায় ব্যাখ্যা করেছি, সেখানে গিয়ে দেখো। এটা ভুল নয়, কিন্তু এতে এক অসাধারণ কিছু মিস হয়ে যায়।

আল্লাহর কুরআনের প্রতিটি সূরা একটি আলাদা উপহার। এর মতো আর কিছু নেই। কুরআনের কোনো সূরা অতিরিক্ত নয়। যেমন তোমার শরীরের কোনো অঙ্গ বাড়তি নয় তেমনই সূরাগুলোর প্রতিটিই অপরিহার্য।

কিন্তু আমাদের মনের ভেতর একটা অলক্ষ্য ধারণা তৈরি হয়েছে আরে, এই সূরাটাও আগের সূরার মতোই তো! এটাই বিপদের শুরু। তাদাব্বুর তখনই সম্ভব, যখন তুমি আল্লাহর বাণীর দরজায় দাঁড়াও বিস্ময় আর ভক্তি নিয়ে।

একটা সহজ উপমা লেগো খেলনার মতো ভাবো। ধরো তোমার কাছে পাঁচটা লেগো বাক্স আছে, সবগুলোতেই একরকম টুকরো আছে। কিন্তু পাঁচজন শিশু এগুলো দিয়ে পাঁচরকম জিনিস বানাবে। কেউ বানাবে রোবট, কেউ ডাইনোসর, কেউ দুর্গ। টুকরোগুলো একই, কিন্তু সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তুমি যদি একটা দালান দেখো, তুমি তো বলো না ইট তো আগেও দেখেছি! বলো ওয়াও! কী দারুণ ডিজাইন! কারণ গঠনটাই একে আলাদা করে তোলে।

তেমনই, সূরাগুলোর ভেতরের উপাদান হয়তো এক, কিন্তু গঠন ও দৃষ্টিভঙ্গি একে সম্পূর্ণ আলাদা করে তোলে।

 

সূরা আন-নাজম-এর কাঠামো আমি ভাগ করেছি পাঁচ ভাগে।

প্রথমত, একটি বিরাট ঘটনা নবী -এর জিবরাঈল (আঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ, একবার দুনিয়ায়, একবার মিরাজে।
তারপর, ভ্রান্ত মুক্তির ধারণা যেখানে মুশরিকরা ফেরেশতাদের সুপারিশকারী ভাবে।
এরপর আসে সত্যিকারের মুক্তি আল্লাহ নিজেই ক্ষমাশীল।
তারপর পুরনো জাতিগুলোর শিক্ষা যারা ওহি প্রত্যাখ্যান করেছে।
শেষে, কিয়ামতের আলোচনা চূড়ান্ত সময় এসে গেছে।

শুরুতে ওহি, শেষে কিয়ামত মাঝখানে মুক্তি ও শিক্ষা। এক অসাধারণ সমান্তরাল গঠন। এই হলো সূরার ডিজাইন।