আজ আমরা সূরা আন-নাজম নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে যাচ্ছি।
গতকাল আমরা কিছু বিষয় নিয়ে একটু একটু করে আলোচনা করেছিলাম। তবে আজ আমরা সেগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি। শুধু এই সূরা নয়, বরং পুরো মাক্কী কুরআনকে বুঝতে এগুলো তোমার জন্য দারুণ সহায়ক হবে।
আল্লাহ যখন এই সূরা শুরু করেন, শুরুই করেন এক ছবি দিয়ে। একটা চিত্র, যা আমাদের মনের চোখ খুলে দেয়। “وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ” — যখন তারকা পতিত হয়। একটা নক্ষত্র, হয়তো রাতের আকাশে উজ্জ্বল ছিল, হঠাৎ ঝরে পড়ল, হারিয়ে গেল।
কিন্তু এটা কেবল নক্ষত্র পতনের দৃশ্য নয়। এই ছবি দিয়ে আল্লাহ আমাদের কিছু দেখাতে চাইছেন। কিছু বোঝাতে চাইছেন। কিছু অনুভব করাতে চাইছেন।
মাক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হল—এগুলোতে বারবার এমন চিত্র দেখা যায়। দৃশ্য, শব্দ, আন্দোলন—সবকিছু যেন একটা ভিজ্যুয়াল আইডিয়া তৈরি করে। এরপর সেই দৃশ্যের পেছনে লুকিয়ে থাকে গভীরতম এক আত্মিক বার্তা।
তোমরা যদি সূরা আদিয়াত পড়ো, সেখানে ঘোড়াগুলোর কথা এসেছে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত, হুংকার দিয়ে, আগুন ছিটিয়ে ছুটে যাচ্ছে। এবং তারপর, আমরা শুনি কীভাবে কিয়ামতের দিন হঠাৎ চলে আসবে—ঠিক যেমন সেই ঘোড়ার দল হঠাৎ তেড়ে আসে।
চিত্র এবং আত্মিক সত্য—এই দুইয়ের সংযোগ মাক্কী কুরআনের সবচেয়ে শক্তিশালী দিকগুলোর একটি।
এখন একটু লক্ষ্য করো—মক্কায় নাজিল হওয়া সূরাগুলোতে কিছু স্পষ্ট, বড় বড় থিম সবসময় ফিরে ফিরে আসে। যেমন ঈমান ও কুফরের দ্বন্দ্ব। জান্নাত এবং জাহান্নামের বর্ণনা। নবীদের কাহিনি। তাওহীদের দাওয়াত।
এই থিমগুলো সবসময়ই থাকে, কিন্তু একেক সূরায় একেকভাবে উপস্থাপিত হয়। ধরো সূরা আল-ইনসান। সেখানে জান্নাতের বর্ণনা এত বিশদ, এত মনোমুগ্ধকর! কিন্তু শাস্তির কথা এসেছে মাত্র এক জায়গায়, খুব সংক্ষেপে।
তারপর তুমি যদি সূরা আল-ক্বিয়ামাহ পড়ো, সেখানে পুরোটা জুড়ে যেন ভয় ছড়িয়ে আছে—আসছে সেই দিন, যেদিন চোখ স্থির হয়ে যাবে, হৃদয় কাঁপবে, আত্মা থরথর করবে। সেখানে জান্নাতের বর্ণনা নেই বললেই চলে।
কেন এমন ভিন্নতা? কারণ প্রতিটি সূরার বার্তা একেক পরিবেশে, একেক শ্রোতাদের জন্য। কোনোটা ভয় দেখায়, কোনোটা আশা জাগায়, কোনোটা প্রশ্ন তোলে, কোনোটা উত্তর দেয়।
তবে সূরাগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা থাকে। এক সূরায় যা বলা হয়েছে, তারই এক রূপান্তর, অথবা আরও গভীর কোনো দিক, আসতে পারে পরের সূরায়।
দারুণ একটা উদাহরণ দিই—সূরা আত-তূর শেষ হয়েছে এই আয়াত দিয়ে: তারকাদের অদৃশ্য হওয়ার মুহূর্তে, রাতের নিঃস্তব্ধতায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করো।
এরপরই শুরু হয় সূরা আন-নাজম: “وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ” — সেই তারকারা পতিত হচ্ছে।
তুমি দেখছো কী চমৎকারভাবে এক সূরা থেকে আরেক সূরায় আল্লাহ এক কথার সুর টেনে নিচ্ছেন? যেন সূরাগুলোর মাঝখানে সেলাই করা হয়েছে আল্লাহর জ্ঞানের সুতো দিয়ে।
এখন একটা ব্যাপার খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলি।
আমরা অনেক সময় একটা আলোচনা করি, একটা ইস্যু নিয়ে কথা বলি, তারপর সেখানে একটা আয়াত ঢুকিয়ে দিই। যেন আয়াতটা হল একটা রেফারেন্স, একটা প্রমাণ। কিন্তু সেটা কি কুরআন পড়া হচ্ছে?
না। এটা হচ্ছে একটা বক্তব্য, আর কুরআনকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেই বক্তব্যকে শক্তিশালী করতে।
কিন্তু তাদাব্বুর — মানে কুরআনের ভেতরে প্রবেশ, শব্দে শব্দে চিন্তা করা— এটা কখনই কুরআনকে রেফারেন্স টুল হিসেবে ব্যবহার করে না। বরং কুরআন হয় কেন্দ্রবিন্দু। কুরআনই হয় আলোচনার সূচনা এবং শেষ।
আমি এই চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম প্রায় ২৩ বছর আগে। তখন থেকে সব বদলে গেছে। তখন বুঝেছি—আমরা অনেক সময় আগে থেকেই একটা পয়েন্ট ঠিক করে ফেলি। তারপর আয়াত খুঁজি সেই পয়েন্টকে প্রমাণ করার জন্য।
এমনকি ইসলামি স্টাডিজে পড়ুয়া ছাত্ররাও যখন কোনো স্কলার-এর লেখা পড়ে, সেখানে যদি একটা আয়াত আসে, তারা অনেক সময় সেটার ওপর গুরুত্ব দেয় না। তারা লেখাটাই পড়ে, আয়াতটা স্কিপ করে দেয়, কারণ “ওটা তো জানি”। এটা একটা বড় সংকেত—তাদের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু কুরআন নয়।
আচ্ছা, এখন তুমি যদি কোনো বক্তব্য দাও, সেটা কার জন্য? শ্রোতা তো একরকম নয়।
তিন ধরনের শ্রোতা হয়—নিরপেক্ষ, যারা শুনছে কিন্তু কোনো অবস্থানে নেই। সন্দেহে আছে, অথবা বিরোধিতায় আছে।
→ যদি কেউ নিরপেক্ষ হয়, একবার জোরে বলা যথেষ্ট।
→ যদি কেউ দ্বিধায় থাকে, একটু বেশি জোর দরকার।
→ কিন্তু যদি কেউ বিরোধিতায় থাকে, তখন বারবার বলতে হয়। বারবার জোর দিতে হয়।
এই কারণেই সূরা আন-নাজম-এর শুরুতেই আমরা দেখি: একের পর এক শপথ, জোরালো ভাষা। কারণ যারা শুনছে, তারা ছিল বিরোধী পক্ষ।
তোমরা যেমন সূরা আর-রহমান শুনে বলো—“ওয়াও! কত সুন্দর তিলাওয়াত!” কিন্তু তুমি বুঝো না, সেখানে বারবার বলা হচ্ছে: “فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ” — “তোমরা আল্লাহর কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” এই পুনরাবৃত্তি একধরনের জোর, চাপ, শক্ত বার্তা। → এবং তা ছিল কুফরিদের উদ্দেশ্যে।
এখন একটা বিশ্বাস আমি খুব দৃঢ়ভাবে ধারণ করি— আল্লাহ যখন একটা সূরা দিয়েছেন, → সেটা শুধু কন্টেন্ট না, → সেটার গঠন, ডিজাইন, বিন্যাস—সবই আল্লাহর হিকমাহর অংশ।
আল্লাহ তো সর্বশ্রেষ্ঠ ডিজাইনার, তাই না?
আমার আঙুলের জয়েন্টগুলো যেমন পরিকল্পিত, সূর্য যেমন তার কক্ষপথে চলে, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ যেমন নিখুঁতভাবে কাজ করে— → তেমনি সূরার প্রতিটি আয়াতও নিখুঁতভাবে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে আছে।
কেউ যদি বলে, কুরআনের সূরাগুলো এলোমেলো, এটা বলছে, হঠাৎ ওটা বলছে— → আমি বলি, কুরআন কখনো এলোমেলো হতে পারে না। কারণ আল্লাহর কোনো কিছু এলোমেলো হয় না।
তুমি হয়তো অনুবাদে পড়লে বুঝতে পারো না, মনে হয় “আরে! এই টপিকটা তো আগেও বলল, আবার কেন বলছে?” কিন্তু তুমি যদি গঠন বিশ্লেষণ করো, দেখবে—আছে এক চমৎকার সংযোগ। → প্রতিটি অংশ অন্যটিকে পূর্ণ করে।
এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস— → আরবি ভাষার শব্দগুলো।
এই ভাষা আমাদের জন্য শুধু ইতিহাস নয়। → এই ভাষা আমাদের হৃদয়ের জন্য একটা উৎস।
একটা আরবি শব্দ, ধরো “هَوَىٰ” — এর মানে শুধু “পতন” নয়, এর মানে আবেগ, প্রবৃত্তি, লোভ, দুর্বলতা।
“ضَلَّ” — মানে শুধু পথ হারানো নয়, বরং আড়ালে চলে যাওয়া, ঢেকে যাওয়া, মিশে যাওয়া এমনভাবে যে আর আলাদা করা যায় না।
একটা শব্দে কত স্তর! কুরআন এই ভাষায় এসেছে, কারণ প্রতিটি শব্দ যেন একেকটা পুষ্টিকর ফল। → প্রাইমারি মিনিং হলো মৌলিক স্বাদ, → সেকেন্ডারি মিনিং হলো তার সুগন্ধ, তার রস, তার রং!
এটা হলো আমাদের জন্য।
এখন কথা হলো—আল্লাহ যখন শপথ করেন, তিনি সেটা উদ্দেশ্যহীন করেন না।
“وَالْعَصْرِ” — সময়ের শপথ “وَاللَّيْلِ” — রাতের শপথ “وَالضُّحَىٰ” — সকালবেলার শপথ
→ সব শপথের পরে আসে এক জবাব। → এটাকে বলা হয় “القسم و جواب القسم” — শপথ এবং তার উত্তর।
যেমন: “وَالْعَصْرِ” — সময়ের শপথ “إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ” — মানুষ তো নিশ্চিত ক্ষতির মাঝে।
তুমি আর যাই হারাও, সময় হারানো সবচেয়ে বড় হারানো। → সময় মানে জীবন, সময় মানে সুযোগ, সময় মানে পরীক্ষার সময়সীমা।
শুধু “ওয়াল্লাহ” বলে থেমে থাকলে তো অর্থ হয় না। → শপথের পরে আসতে হয় আসল বক্তব্য। → ঠিক তেমনি কুরআনের শপথের পরে আসে সেই মহান ঘোষণা, যা আমাদের মনোযোগ টেনে নেয়।
এভাবে কুরআনের তাদাব্বুর শুরু হয়— → শব্দে শব্দে চিন্তা → আয়াতে আয়াতে সংযোগ → এবং হৃদয়ে কুরআনের বার্তা।