ইসলামী জ্ঞানচর্চায় আমরা অনেক কিছু অনুমান করে নিই। আর যখন আপনি সেই অনুমানের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন, তখন বলা হয়, “কে আপনি যে অনুমানকে প্রশ্ন করবেন? আপনি কি তাদের মতো জ্ঞানী? আপনি কি এই ব্যক্তির মতো জ্ঞানী?” না, আমি তাদের মতো নই, কিন্তু এটা তো একটা অনুমানই। এটা হয়তো অনেক ভালো একজন মানুষের কাছ থেকে আসা অনুমান।
কিন্তু তারপরেও তা অনুমানই। আল্লাহ আমাদের এমন এক দ্বীন দিয়েছেন যা বিপ্লবী। এই দ্বীনের কোনো অংশই কিসের ওপর ভিত্তি করে হতে পারে না? অনুমান।
একদমই না। এর ভিত্তি হতে হবে সুদৃঢ়। এর শিকড় গভীরে প্রোথিত, আর এর শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত।
এটাই হলো আমাদের দ্বীন। এটা এক গভীর ধর্ম। এটা শুধু অনুভূতির ওপর চলে না।
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
[সূরা আন-নাজম, ৫৩:২৮]
যাইহোক, আমি যে বলেছিলাম এই আয়াতের 'মুদারী' বা বর্তমান/ভবিষ্যৎ কালের রূপ, তার মানে হলো—এই অনুমানের অনুসরণ মানবজাতির জন্য বিচার দিবস পর্যন্ত একটি সমস্যা হয়ে থাকবে। এই অনুমান এক ধরনের উপাস্যে পরিণত হবে। অনুমান একটা মিথ্যা উপাস্য বা মূর্তির মতো হবে, যাকে কুরআন চূর্ণবিচূর্ণ করতে থাকবে এবং কুরআনের অনুসারীরাও বিচার দিবস পর্যন্ত তা ভাঙতে থাকবে।
এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। আর এরপর তিনি (আল্লাহ) বলেন:
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
অনুমান আপনাকে সত্যের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারে না। আমি আপনাদের বলি আমাদের সময়ে অনুমান কীভাবে কাজ করে।
আপনাদের এক-দু'টো উদাহরণ দিই। ধরুন, এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলি যা নিয়ে মানুষ খুব উত্তেজিত হয়ে যায়। চলুন, পুলিশি নির্যাতন নিয়ে কথা বলি।
ঠিক আছে? আপনি একটা ভিডিও দেখলেন, একজন পুলিশ অফিসার কাউকে মারধর করছে। "ওহ্ মাই গড, আমি পুলিশি নির্যাতন ঘৃণা করি।" এবার, আপনি আরেকটি ভিডিও দেখলেন যেখানে একজন পুলিশ অফিসার কাউকে জাপটে ধরেছে।
আপনি পুরো ঘটনা জানার আগেই সাথে সাথে কী বলে চিৎকার করবেন? "পুলিশি নির্যাতন!" আপনি জানেন না যে লোকটা ছুরি বের করে পুলিশ অফিসারকে মারতে গিয়েছিল কি না। আপনি জানেন না সে বন্দুক চালিয়েছিল কি না।
আপনি জানেন না সে কোনো শিশুকে মেরেছিল কি না। আপনি কিছুই জানেন না। আপনি শুধু একটা ক্লিপ দেখেছেন যেখানে একজন পুলিশ অফিসার একটা লোককে ধরেছে আর সে এমন করছে।
এখন, এটা পুলিশি নির্যাতন হতেও পারে, আবার একটা আইনসম্মত গ্রেফতারও হতে পারে। আমার কাছে যথেষ্ট তথ্য নেই যে আমি কোনো রায় দিতে পারব, কারণ আমার কাছে তথ্যের একটি অংশ আছে, পুরো চিত্রটা নেই। কিন্তু আপনারা জানেন, যখন আপনার কাছে সামান্য তথ্য থাকে আর বাকিটা আপনি নিজে থেকে ধরে নেন, তখন তাকে কী বলে? তাকে বলে 'যন' (ظَنّ)।
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
'যন', অর্থাৎ অল্প তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা অনুমান, আপনাকে প্রকৃত সত্য থেকে মুক্তি দিতে পারে না। এটা আপনাকে পরিস্থিতির বাস্তবতার বিরুদ্ধে কোনো সাহায্য করতে পারবে না।
আচ্ছা, চলুন পুলিশি নির্যাতন নিয়ে কথা না বলি। আসুন আমাদের নিজেদের ধর্ম নিয়েই এক মুহূর্তের জন্য কথা বলি।
আমি আপনাদের একটা উদাহরণ দিই। একটি বিখ্যাত ঘটনা—আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ) এক বর্ণনায় তাঁর ছেলেকে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেছিলেন।
আবু বকর (রাঃ) তাঁর ছেলেকে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেছিলেন। আমি একবার এক হালাক্বায় ছিলাম এবং যে শাইখ এই ঘটনাটি বর্ণনা করছিলেন, তিনি বললেন, "এটা পিতামাতার অধিকার। এমনকি যদি পিতামাতা তোমাকে তোমার স্ত্রীকে তালাক দিতেও বলেন, তোমার কী করা উচিত? স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেওয়া উচিত।"
আমি মনে মনে বললাম, "ওহ্? কী? কী বললেন ভাই আপনি? শাইখ ব্রো? এক মুহূর্ত থামুন তো।"
আমি কিছু প্রশ্ন করি। বিয়ে। দু'জন মানুষের মধ্যে হয়। আপনি কি কারও বিয়ে সম্পর্কে সবকিছু এমনিতেই জেনে ফেলতে পারেন? আপনি কি সেই বিয়ে সম্পর্কে সবকিছু জানেন? সেই সম্পর্ক নিয়ে সবকিছু? না।
সব বিয়ে কি একই রকম? না। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কি শুধুই আধ্যাত্মিক, শুধুই অর্থনৈতিক, শুধুই আবেগগত, বা শুধুই পারিবারিক? নাকি এটা অনেক কিছুর মিশ্রণ? এটা অনেক কিছুর মিশ্রণ।
আর যদি কোনো বিয়ে ঠিকমতো না চলে, তার কি একটাই কারণ থাকতে পারে? একটা সাধারণ কারণ? নাকি অনেকগুলো জটিল কারণ থাকতে পারে? নাকি সাধারণত একটাই সোজাসাপ্টা কারণ থাকে? এটা একটা বিশাল জটিল বিষয়। এর পেছনে এক দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস থাকে। এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়।
গল্পে বলা হচ্ছে, আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ) তাঁর ছেলেকে তার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেছিলেন।
আপনার কাছে কতটুকু তথ্য আছে? এটা অনেকটা, দরজার চাবির ফুটো দিয়ে ঘরের ভেতরে দেখার মতো। আপনি ঘরের কতটুকু দেখতে পান? এই এতটুকু? আর আপনি বলছেন, "আমি বলে দেব ওই ঘরের সব আসবাবপত্র কোথায় আছে। আমি বলে দেব আলমারির ভেতরে কী কী আছে।" কী বোকামি!
আপনি কিছুই জানেন না। আপনার কাছে শুধু এইটুকু তথ্য আছে। বাকি যা কিছু আপনি বলছেন, তা কী? 'যন'।
এখন, বাকি পরিস্থিতি না জেনেই আপনার এটা বলা—যেহেতু আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন, তাই এটা একটা নিয়ম। আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ) তো খুব কম কথা বলতেন! আপনি বুখারী আর মুসলিম পড়ুন, দেখবেন আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা হাতে গোনা যায়।
তাই যখন তিনি কথা বলেন, আমরা তাঁর কাছ থেকে খুব কমই জানতে পারি। সুতরাং, আমরা তাঁর সম্পর্কে যা জানি, তা হলো, যদি তিনি তাঁর ছেলেকে স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেও থাকেন, আমরা জানি না তিনি তাকে আদেশ দিয়েছিলেন নাকি অনুমতি দিয়েছিলেন। আমরা জানি না তার ছেলে কতবার তাঁর কাছে এসে বলেছিল, "বাবা, আমি আর পারছি না। আমি জানি না। সম্পর্কটা টিকছে না।" কতবার তিনি ছেলেকে বলেছিলেন, "বিয়েটা টিকিয়ে রাখো, টিকিয়ে রাখো।" আর হয়তো একদিন তিনি বলেছিলেন, "তালাক দিয়ে দাও।"
আমরা কিছুই জানি না। কিচ্ছু না। একটা ডেটা পয়েন্ট, দুটো ডেটা পয়েন্ট।
আর আমরা আমাদের ইতিহাসের এই গল্পগুলো দিয়ে কী করি? আমরা কী তৈরি করি? অনুমানের এক বিশাল পাহাড়। আর তারপর সেগুলোকে আমরা বাস্তব সত্য হিসেবে পেশ করি।
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
আপনি হয়তো বলবেন, "ওহ্, অন্য ধর্মেও তো এমনটা হয়।"
আমি গত ২৩ বছর ধরে ইসলাম শেখার চেষ্টা করছি। আর আমি এখনও একজন ছাত্র। আমি কোনো শাইখ নই। বড়জোর মিল্কশেক বলতে পারেন। আচ্ছা, যাক, কেউ একজন জোকটা ধরেছে। আমি এখন খুশি।
আমি আপনাদের একটা কথা বলি। ইসলামে অনেক অনুমান বিদ্যমান।
আর এখানে বিভিন্ন স্তর আছে।
هُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ اللَّهِ
(আল্লাহর নিকট তারা বিভিন্ন স্তরের।)
[সূরা আলে ইমরান, ৩:১৬৩]
জ্ঞানের বিভিন্ন স্তর রয়েছে। কিছু মানুষ আছেন যাদের জ্ঞান হয়তো অষ্টম শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা লেভেলের। কিন্তু যেহেতু তারা এমন এক সমাজে থাকেন যেখানে বাকি সবাই কিন্ডারগার্টেন লেভেলের, তাই তাদেরকে 'শাইখুল ইসলাম' মনে হয়।
তখন তারা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। যেমনটা আমি আপনাদের এইমাত্র বললাম। আর সবাই বলে, "মাশাআল্লাহ!"
"ওহ্, এই গল্প শুনে আমার ঈমান বেড়ে গেল। আমি বাড়ি যাচ্ছি, কারণ আমার মা আমাকে আমার স্ত্রীকে তালাক দিতে বলেছেন। আর আমি আবু বকর আস-সিদ্দীক (রাঃ)-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করব।"
কারণ আপনার জ্ঞান অষ্টম শ্রেণির, আর আপনি অন্ধদের পথ দেখাচ্ছেন।
এরপরে এর চেয়ে উঁচু স্তর রয়েছে। সেখানে আপনি আলেমদের পাবেন, সত্যিকারের আলেম। আর আল্লাহ আমার জন্য এমন সব দরজা খুলে দিয়েছেন যা আমি ব্যাখ্যাও করতে পারব না যে তিনি কীভাবে খুলেছেন। আমি বিশ্বের সেরা কিছু আলেমের সাথে দেখা করার সুযোগ পাই।
আর আমি আপনাদের বলছি, তারা যত বড় আলেম, তত কম কথা বলেন। আপনি তাদের ইউটিউবে দেখবেন না। আপনি তাদের খুব কমই দেখবেন। আর যদি দেখেনও, তাদের ভিডিওতে হয়তো ৮০টা ভিউ থাকে। কারণ তাদের মস্তিষ্ক এমন এক ফ্রিকোয়েন্সিতে কাজ করে যা দেখে বাকিরা বলে, "এটা তো মজার ছিল না। এটা আকর্ষণীয় ছিল না। এটা বিনোদনমূলক ছিল না।" বুঝলেন?
তাই যখন আমি তাদের সাথে কথা বলি, আমি ইসলামের এক ভিন্ন চিত্র পাই। সেই একই গল্পগুলো সম্পর্কে, যা আমি ছোটবেলা থেকে জুমু'আর খুতবায় শুনে আসছি। আর আমি তাদের কথা শুনি আর ভাবি, "এ কী!"
জানেন কেন? এই আয়াতের কারণে:
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
'হক্ব' (সত্য) তো 'হক্ব'-ই। আর আমাদের যথেষ্ট সাহসী হতে হবে এর মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আমাদের এর মোকাবিলা করতে হবে। আর আমাদের নিজেদের ধর্মের ভেতরে থাকা অনুমানের জগতকেও ভাঙতে হবে। প্রশ্ন করুন। উত্তর খুঁজুন। দৃঢ় প্রত্যয় বা এক্বীন অন্বেষণ করুন। প্রশ্ন করতে ভয় পাবেন না।
আর বিশ্বের বিশাল এক জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে। বিশাল এক অংশ। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আপনি যদি ৩,০০০ মাইলের একটা বৃত্ত আঁকেন, তাহলে দেখবেন ৭৫% মানুষ সেখানেই বাস করে। আর জানেন, সবচেয়ে বেশি শিরকও সেখানেই হয়। আর অধিকাংশ মুসলিমও সেখানেই বাস করে।
ইন্দোনেশিয়া বিশ্বের সেই অংশেই অবস্থিত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান। ভারতের মুসলিমরা। এরা মুসলিমদের বিশাল জনগোষ্ঠী। আর আপনি যদি পাকিস্তানের মতো জায়গায় যান, দেখবেন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে একটা খুব সাধারণ কথা প্রচলিত আছে, তারা বলে: "কুরআন পড়ো না, পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।"
'যন' বা অনুমান ধরে রাখো। 'হক্ব' বা সত্যের দিকে যেও না।
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
আমি চলে যাওয়ার আগে আপনাদের এটা জানা দরকার যে 'হক্ব' (حَقّ) এর তিনটি অর্থ রয়েছে। অন্তত এই আয়াতের প্রেক্ষাপটে। 'হক্ব', আপনাদের জানতে হবে, এর তিনটি অর্থ আছে।
'হক্ব' মানে হলো বাস্তবতা। তাই অনুমান বাস্তবতাকে বদলাতে পারে না। তারা আপনাকে বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্তি দেবে না।
'হক্ব'-এর আরেক অর্থ হলো সত্য।
এবং 'হক্ব'-এর আরও একটি অর্থ হলো উদ্দেশ্য।
জানেন এর মানে কী? যারা অনুমানের ওপর জীবন কাটায়, তারা কখনো কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। আপনি যদি অনুমানের জগতে বাস করেন, আপনি উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচতে পারবেন না।
কারণ,
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
আরবীতে 'হক্ব' এর আরও একটি অর্থ আছে, যা এই আয়াতের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়, কিন্তু আপনাদের জানা উচিত। এর মানে হলো অধিকার। যেমন, حَقُّ السَّائِلِ وَالْمَحْرُومِ (ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের অধিকার), حَقُّ الْوَالِدَيْنِ (পিতামাতার অধিকার)।
কিন্তু সত্য, বাস্তবতা এবং উদ্দেশ্য—এই তিনটি জিনিসই ‘হক্ব’ শব্দের মধ্যে মিশে আছে। আর আমি চাই আপনারা এটা জানুন, কারণ আল্লাহ বলছেন, তোমরা এমন সব ধর্ম তৈরি করেছ যার কোনো সত্য নেই, কোনো বাস্তবতা নেই এবং কোনো উদ্দেশ্যও নেই। আর কুরআন হলো সত্য, এটি বাস্তবতাকে ঠিক সেভাবেই বর্ণনা করে যেমনটা তা আছে, এবং এটি আপনার ও আমার জীবনকে একটি উদ্দেশ্য দান করে। এই তিনটি জিনিসই এক হয়ে যায় এই আয়াতে:
وَإِنَّ الظَّنَّ لَا يُغْنِي مِنَ الْحَقِّ شَيْئًا
(আর নিশ্চয় অনুমান সত্যের মোকাবেলায় কোনোই কাজে আসে না।)
আলহামদুলিল্লাহ, আমরা আজকের আলোচনার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।
যাওয়ার আগে, আমি আপনাদের শুধু একটা ছোট্ট লেন্স বা দৃষ্টিভঙ্গি দেব। আমার সাথে একটু থাকুন। আমরা কুরআন নিয়ে চিন্তা করার লেন্সগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাইনি। ওয়ার্কবুকটা আপনাদের সাথেই ছিল। এখন পর্যন্ত এটা শুধু পাসপোর্টের মতোই ব্যবহার হয়েছে। তাই আজ আমি আপনাদের শুধু একটা লেন্স দেব, আর বাকিগুলো নিয়ে পরে কথা বলব।
তো, এখানে বলা আছে 'ভাষার লেন্স'। একটি লেন্সের নাম হলো 'ভাষার লেন্স'। আমার এটা নিয়ে কথা বলার দরকার নেই, কারণ আমি আপনাদের সূরা নাজমে এ পর্যন্ত ভাষার লেন্সের একটা ভালো স্বাদ দিয়েছি। প্রত্যেকটা শব্দ, এর ব্যাকরণগত প্রভাব, এখানে 'মিন' কী করছে, এর দ্বিতীয় অর্থ কী—এগুলো সবই কিসের লেন্স? ভাষার। আর একারণেই ভাষা আপনার জন্য তাদাব্বুর বা গভীর চিন্তার দরজা খুলে দেবে। আর যদি আপনার কাছে সেই সুযোগ না থাকে, শেষ দিনে, এমনকি যদি আপনি আরবি নাও জানেন, আমি আপনাদের এমন কিছু টুলস দেওয়া শুরু করব যা দিয়ে আপনি নিজেই এই লেন্সগুলোর কিছু কিছু ব্যবহার করতে পারবেন।
ঠিক আছে? কিন্তু দ্বিতীয় যে ছোট্ট লেন্সটা আমি আপনাদের দিতে চাই, তা হলো 'কুরআনের জগত'। লেন্সটির নাম 'কুরআনের জগত'। এর মানে কী?
যখন আল্লাহ প্রাচীন মিশরে ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে কথা বলছিলেন, জানেন আমার প্রিয় বন্ধু শাইখ সোহাইব সাঈদ কী করেন? কুরআন অধ্যয়নের সময় তিনি আর আমি একই পথের পথিক। আরও কয়েকজন আছে। কিন্তু যখন আমরা সূরা ইউসুফ পড়ছিলাম, আমরা আক্ষরিক অর্থেই কল্পনা করতাম যে আমরা প্রাচীন মিশরে বাস করছি।
কেমন ছিল সেই মিশর? বাজারগুলো কেমন ছিল? নারীরা কেমন ছিল? যে নারীরা ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে কথা বলছিল। সেই পার্টিটা কেমন ছিল? পানীয়গুলো কেমন ছিল? ভৃত্যরা কেমন ছিল? সেই পরিবেশটা কেমন ছিল? আমি নিজেকে যতটা সম্ভব সেই পরিবেশে স্থাপন করতে চাই। তাই সূরা ইউসুফ বোঝার জন্য আমরা আসলে মিশরের ইতিহাস এবং সেখানকার জীবনযাত্রা ও সমাজব্যবস্থা নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। কারণ আল্লাহ যদি কোনো একটা জগতের কথা বলেন, আমি সেই জগতের ভেতরে যেতে চাই।
আমরা সূরা যারিয়াত (৫১) পড়ছিলাম। আল্লাহ শুরুতে বাতাসের কথা বলছেন। জানেন আমরা কী করেছিলাম? শুধু তাফসীর পড়ার বদলে, এর পাশাপাশি আমরা বাতাস নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি বাতাস নিয়ে ডকুমেন্টারি দেখেছি। বাতাস নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাপত্র পড়েছি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে বাতাস নিয়ে পড়েছি।
আল্লাহ বলেন, "কসম সেই বায়ুর যা ধূলিকণা উড়িয়ে নিয়ে যায়," আর এর অর্থ দাঁড়ায় এমন বাতাস যা বহুদূর পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যায়। আমি জানতামই না যে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির বালি বাতাসে ভেসে ফ্লোরিডার উপকূলে গিয়ে পড়ে। আমি এটা জানতাম না। পুরো মহাসাগর পাড়ি দিয়ে।
وَالذَّارِيَاتِ ذَرْوًا
(কসম সে বায়ুর যা ধূলিকণা উড়ায়।)
আমি জানতাম না যে বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, পুরো জলবায়ু, বাতাসের মাধ্যমে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে বাহিত হয়।
فَالْحَامِلَاتِ وِقْرًا
(অতঃপর কসম বোঝা বহনকারী মেঘের।)
আমি জানতাম না যে এক জায়গায় যখন শান্ত আবহাওয়া থাকে, তখন তা একটি শূন্যতা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপ তৈরি করে এবং অন্য জায়গায় বজ্রপাত, হারিকেন ও টর্নেডো সৃষ্টি করে।
فَالْمُقَسِّمَاتِ أَمْرًا
(অতঃপর কসম সে বায়ুর যা কর্ম বন্টন করে।)
আমি জানতাম না। কিন্তু আমি যত বাতাস নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তত আমি উপলব্ধি করেছি যে, আমি সূরা যারিয়াতের শুরুতে আগের চেয়ে অনেক বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছি।
আমি আপনাদের কী বোঝাতে চাচ্ছি? যদি আল্লাহ পাহাড়ের কথা বলেন, তাহলে তাদাব্বুর করার জন্য আপনার সবচেয়ে ভালো কাজ হবে—যদি আপনি তাফসীর করতে চান, ইবনে কাসীর খুলুন, রাযী খুলুন, কোনো অনুবাদ গ্রন্থ খুলুন, যা খুশি। কিন্তু যদি আপনি তাদাব্বুর করতে চান, পাহাড়ের ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখুন।
যদি আপনি জানতে চান, যদি আল্লাহ মৌমাছির কথা বলেন, মৌমাছি নিয়ে পড়া শুরু করুন। তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করুন। তাদের সম্পর্কে জানুন। আর তারপর আয়াতটি পড়ুন। দেখবেন আয়াতটি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে।
যখন আল্লাহ ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর স্ত্রী, অর্থাৎ সেই সময়ে ইসহাক (আঃ)-এর মায়ের কথা বলছিলেন… আসলে ইসমাইল (আঃ)-এর সময়। ফেরেশতারা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কাছে এসেছিলেন। তারা বললেন, "আপনার একটি সন্তান হবে।" আর তাঁর স্ত্রী বলে উঠলেন, "কী? عَجُوزٌ عَقِيمٌ (এক বৃদ্ধা বন্ধ্যা নারী)!" আর তিনি নিজের মুখে চড় মারলেন।
তিনি মুখে চড় মেরে চিৎকার করে উঠলেন।
فَصَكَّتْ وَجْهَهَا وَقَالَتْ عَجُوزٌ عَقِيمٌ
(তখন সে চিৎকারে তার নিজ মুখে আঘাত করল এবং বলল, ‘(আমি তো) এক বৃদ্ধা, বন্ধ্যা।’)
[সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:২৯]
আক্ষরিক অর্থেই তিনি এমনটা করেছিলেন। "এক বৃদ্ধা নারী। যে কখনো বাচ্চা জন্ম দিতে পারেনি।" তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন।
এখন, এক মুহূর্তের জন্য এটা নিয়ে ভাবুন। আমার সাথে থাকুন। এরপরই আপনাদের ছেড়ে দেব।
ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) কতদিন বেঁচে ছিলেন? ১০০ বছরেরও বেশি। কুরআনে তাঁর কতটুকু কথোপকথন আছে? বড়জোর ৩০ মিনিটের মতো। আপনি যদি কুরআনে থাকা ইবরাহীম (আঃ)-এর কথোপকথন রেকর্ড করেন, তাঁর ১০০ বছরেরও বেশি জীবনের ৩০ মিনিটের বেশি হবে না।
আমি তাঁর জীবনের প্রতিটি মিনিট জানতে চাই। কিন্তু আল্লাহ আমাকে তা দেননি। আল্লাহ আমাকে কতটুকু দিয়েছেন? তাঁর জীবন থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের একটি রেকর্ডিং।
তার মানে আল্লাহ বাছাই করেছেন, তাই না? কারণ আল্লাহ খুব নির্বাচিতভাবে তথ্য দেন। তাই কুরআনের প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত নির্বাচিত। কারণ অনেক তথ্য বাদ দিয়ে খুব অল্প তথ্য দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, যে তথ্যটুকু রাখা হয়েছে, তা আল্লাহ কর্তৃক অত্যন্ত নির্বাচিত।
আর তাঁর জীবনের সবচেয়ে নির্বাচিত মুহূর্তগুলোর মধ্যে, কেন আমার এটা জানার প্রয়োজন ছিল যে এই নারীটি তাঁর মুখে চড় মেরেছিলেন? এই নির্বাচনের কারণ কী? এটা নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন তিনি বলছেন, "আমার সন্তান হতে পারে না। আর আমি কোনোদিনও সন্তান জন্ম দিতে পারিনি। আর এখন আমি এক বৃদ্ধা।" সুতরাং, 'বৃদ্ধা' এবং 'বন্ধ্যা' শব্দ দুটি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাঁর মুখে আঘাত করে কান্নার আবেগটিও গুরুত্বপূর্ণ।
তাই জানেন আমরা কী করেছিলাম? আমরা তাফসীরগুলো পড়েছি আর তারপর আমরা বন্ধ্যাত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমরা সেইসব নারীদের মধ্যে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার হার নিয়ে গবেষণাপত্র পড়েছি যারা সন্তান জন্ম দিতে পারে না এবং বিশ্বজুড়ে বন্ধ্যাত্বের হার ও বয়স্ক নারীদের অনুভূতি, যারা কখনো মা হতে পারেননি। আমরা এগুলো নিয়ে গবেষণা করেছি। আমি এই নারীর আবেগ বুঝতে চেয়েছি কারণ আল্লাহ তাঁর আবেগ এবং যে দুটি শব্দ দিয়ে তিনি নিজেকে পরিচিত করেছিলেন, তা রেকর্ড করেছেন। আল্লাহ কুরআনে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কথা রাখেননি। তিনি তাঁর (স্ত্রীর) কথা রেখেছেন এবং তারপর ফেরেশতারা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে কথা বলার পরিবর্তে তাঁর সাথেই কথা বলেছেন। ফেরেশতারা ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে বলেননি, "ইয়া ইবরাহীম, আল্লাহ আমাদের আপনার সাথে কথা বলতে পাঠিয়েছেন। আপনি কি দয়া করে আপনার স্ত্রীকে একটু সামলাবেন? ভদ্রমহিলা কিছুটা মানসিক স্থিরতা হারাচ্ছেন। আপনি কি… আপনি কি আপনার পরিবারকে সামলাতে পারেন?" তিনি এমনটা করেননি।
জানেন ফেরেশতারা কী করেছিলেন? তারা সেই নারীর সাথেই কথা বলতে শুরু করলেন। এটা আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ ছিল, কারণ ফেরেশতারা কোনো কিছু করেন না যতক্ষণ না আল্লাহ হুকুম দেন। আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল যে ফেরেশতারা এই নারীর সাথে কথা বলবেন। আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল যে এই নারী নিজের মুখে চড় মারবেন আর সেই চড়ের দৃশ্য বিচার দিবস পর্যন্ত রেকর্ড হয়ে থাকবে।
আমি আপনাদেরকে কুরআনের জগতের ব্যাপারে কী বোঝাতে চাচ্ছি জানেন? কুরআন যখন কিছু বলে, আমি এর গভীরে ডুব দিতে চাই। আমি সেই জগতে প্রবেশ করতে চাই। আমি সেই ঘরে উপস্থিত থাকতে চাই। আমি সেই পাহাড়ে থাকতে চাই।
আমি এটাই চাই আপনারা করুন। কুরআন যখন কথা বলে, তখন আমাকে কোন জগতে প্রবেশ করতে বলছে?
যখন আল্লাহ নক্ষত্রের কথা বলা শুরু করলেন, আমি আপনাদের নক্ষত্রের জগতে নিয়ে গিয়েছিলাম, তাই না? যখন আল্লাহ মিথ্যা উপাস্যদের কথা বলেন, আমাদের প্রাচীন আরবের জগতে যেতে হবে, তাই না? তিনি আমাকে কোন জগতে প্রবেশ করাতে চাইছেন?
এটা আপনার জন্য তাদাব্বুরের নতুন দরজা খুলে দেবে। নতুন দরজা। এরপর থেকে কুরআন এক ভিন্ন বইয়ে পরিণত হবে।
সুতরাং, প্রথম লেন্স হলো 'ভাষার লেন্স', আর দ্বিতীয় লেন্স হলো 'কুরআনের জগত'।
আপনাদের সন্ধ্যা সুন্দর হোক।