সুরা আন নাজম (পর্বঃ১৪)

Spread the love

সংক্ষিপ্ত ভাষায় এতগুলো মহাজাগতিক ঘটনা, আকাশে ঘটে চলা এতকিছুর এমন অবিশ্বাস্য চিত্রায়ন আর কোথাও পাওয়া যাবে না, যা শুধু এই একটি বাক্যে ধারণ করা হয়েছে: وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ (শপথ তারকার, যখন তা অস্তমিত হয়)। শুধু এইটুকু। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুরো অভিজ্ঞতাকে আকাশের বুকে ঘটে চলা ঘটনার ওপর স্থাপন করা হয়েছে। وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ (শপথ তারকার, যখন তা অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি।)

আমি এই বিষয়টি আগেই আপনাদের কাছে বর্ণনা করেছি। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি কী দেখেছিলেন? আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ
(সে তো তার রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহের অন্যতম নিদর্শন দেখেছে।) [সূরা আন-নাজম ৫৩:১৮]
তিনি অবশ্যই আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিদর্শনগুলোর একটি দেখেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি ঠিক কী দেখেছিলেন? ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, তিনি আল্লাহকে দেখেছিলেন।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, না, তিনি দেখেননি। একটি হাদীসে আছে, "আমি কীভাবে দেখতে পারি? তিনি তো নূর (আলো) ছিলেন।" আরেকটি হাদীসে আছে, "আমি নূর (আলো) দেখেছিলাম।" আমি কিছু আলো দেখেছিলাম। এখানে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। আর কুরআন বলছে, কোনো কিছু সেটিকে ঢেকে ফেলেছিল।

তাহলে আল্লাহ কি আমাদের জানাতে চেয়েছিলেন যে তিনি কী দেখেছিলেন? না। আল্লাহ আমাদের এটা জানাতে চেয়েছিলেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মাঝে একটি গোপনীয়তা আছে। এমন কিছু আছে যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দেওয়া হয়েছিল, যেন তিনি তা মানবজাতির কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু রাসূল (ﷺ) আল্লাহর কাছে এতটাই বিশেষ ছিলেন যে, আল্লাহ তাঁর রাসূলকে কিছু জিনিস শুধু তাঁর নিজের জন্যই দিয়েছিলেন, আর আপনাদের এটা জানা উচিত। আপনাদের জানা উচিত যে, কিছু বিষয় শুধু আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

সেটা কি অন্য কিছু ছিল? অন্য কোনো আলো ছিল? নাকি তা স্বয়ং আল্লাহ ছিলেন? আল্লাহ তো নিজেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন:
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ
(আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর।) [সূরা আন-নূর ২৪:৩৫]
সুতরাং কেউ এসে বলতে পারে না যে, তিনি আল্লাহকে দেখেননি। আবার কেউ এসে এটাও বলতে পারে না যে, তিনি আল্লাহকে দেখেছেন। আমরা শুধু এতটুকুই বলতে পারি যে, তিনি কিছু একটা দেখেছিলেন। তিনি কিছু একটা দেখেছিলেন এবং তাঁর চোখ বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হয়নি। আমরা কেবল এটুকুই জানি। আল্লাহ আমাদের শুধু এটুকুই জানাবেন।

কিন্তু আমি চাই আপনারা এই শব্দটির ওপর মনোযোগ দিন—رَأَىٰ (রা'আ), তিনি দেখেছেন। তিনি দেখেছেন। তিনি দেখেছেন। আপনারা কি আমার সাথে আছেন তো? এবার আসল মজার অংশে আসা যাক। তো, এই হলো পৃথিবী গ্রহ। এই হলো আমার আঁকার হাত। ঠিক আছে, এই হলো আমাদের গ্রহ। দেখুন, এর ওপর আমি কয়েকটি মহাদেশ এঁকে দিই। বেশ, আপনি এখানে আছেন। একজন ব্যক্তি। একজন প্রাচীন আরব। এই সেই প্রাচীন আরব, এখানে, এই পৃথিবী গ্রহে। আর তার ওপরে সে দেখছে দিগন্ত। ঠিক আছে, ওটা হলো দিগন্ত—পূর্ব ও পশ্চিম। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আর সূর্য পশ্চিমে অস্ত যায়। সূর্য পূর্ব দিক থেকে উদিত হয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। ঐ দিকে। এই পর্যন্ত আমার সাথে আছেন তো? সহজ, তাই না? এটা হলো ফজর। আর এটা কী? ইশা নয়, মাগরিব। ঠিক আছে।

এবার রাত নেমে আসে। আপনাদের অনেকেই জানেন না, পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট দিকে ঘুরছে। সূর্য তো কেবল একটি নক্ষত্র। কিন্তু যে নক্ষত্রগুলো বহু দূরের ছায়াপথে বা মহাবিশ্বে আছে, সেগুলোও পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং পশ্চিমে অস্ত যায়। ছায়াপথের সমস্ত তারা আসলে এক রাতের মধ্যে কিছুটা পথ পাড়ি দেয়। কিন্তু তারা পুরোটা পথ পাড়ি দেয় না। কিছু কিছুটা সরে, কিছু আরেকটু বেশি সরে, আবার কিছু আরও বেশি সরে। কারণ এটা তাদের দূরত্বের ওপর নির্ভর করে। আমার কথা বুঝতে পারছেন?

তো, সূর্য এভাবে যায়। কিন্তু তারাও এভাবেই যায়। এই পর্যন্ত আমার সাথে আছেন তো? ঠিক আছে।

এক বিশেষ ধরনের তারকাগুচ্ছ আছে, যাকে বলা হয় ‘নাজম’ (Najm)। আরবি কবিতা ও সাহিত্যে ‘নাজম’ বলতে শুধু সব তারকাকে বোঝানো হয় না। এক বিশেষ তারকাগুচ্ছকে ‘নাজম’ বলা হয়। ইংরেজিতে আমরা একে বলি Pleiades (প্লেয়াডিস) বা কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ। এর বানানটা বেশ কঠিন, আপনারা গুগল করে নিতে পারেন। Pleiades শুধু একটি তারকা নয়, এটি একটি তারকাদের সমষ্টি বা নক্ষত্রপুঞ্জ।

শীতকালে, মক্কায় আপনি এই Pleiades-কে ঠিক মাথার ওপরে দেখতে পাবেন। আমরা মক্কার কথা বলছি। আপনি যদি নিউ জার্সির কোথাও থাকেন, তাহলে আমি জানি না। কিন্তু মক্কায়, শীতকালে, জানুয়ারি মাসে যদি আপনি সোজা ওপরের দিকে তাকাতেন, তাহলে কী দেখতে পেতেন? ‘আন-নাজম’। আর ‘আন-নাজম’ হলো একগুচ্ছ তারা। তো, রাত যত গভীর হয়, তারা এখানে থাকে, ভ্রমণ করতে থাকে। এর মানে হলো, তারা উঁচু থেকে শুরু করে নিচুতে গিয়ে শেষ হয়। আমার সাথে আছেন তো? Pleiades। আর কোন ঋতুতে? শীতকালে।

কিন্তু এরপর আসে গ্রীষ্মকাল। যাইহোক, যখন রাত শেষ হয়, তখন তারা তাদের বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে এবং আপনি তা দেখতে পান না, কারণ তখন তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে থাকে। তারপর গ্রীষ্মকাল আসে। আর এখন তারাগুলো কোথায় দেখা যাবে? মাথার ওপরে নয়। কোথায় দেখা যাবে? ঠিক এইখানে। গ্রীষ্মকালে Pleiades সূর্য এর ঠিক পেছনেই থাকে। তাই আপনি ফজরের কয়েক মিনিট বা কয়েক সেকেন্ড আগে একে দেখতে পান। কিন্তু তারপরেই সূর্য চলে আসে। আর সূর্য যখন আসে, তখন Pleiades-এর কী হয়? তা অদৃশ্য হয়ে যায়। তাই শীতকালে আপনি এটি দীর্ঘ সময় ধরে পরিষ্কারভাবে দেখতে পান, কিন্তু গ্রীষ্মকালে আপনি এটি কেবল এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পান। এই পর্যন্ত আমার সাথে আছেন তো?

আচ্ছা, তাহলে আরবিতে Pleiades-কে কী বলা হয়? আরবি কবিতায়? ‘আন-নাজম’ (An-Najm)। আর আমরা কোন দুটি অবস্থান নিয়ে আগ্রহী? একটি হলো মাথার ওপরেরটি এবং অন্যটি হলো পূর্ব দিকেরটি। কোনটি সবচেয়ে কম সময়ের জন্য দেখা যায়? পূর্বেরটি। কেন? কারণ কোনটি তাকে ঢেকে দেয়? সূর্য। শুনুন, আমার সাথে আছেন তো?

আচ্ছা, আর একটি শেষ কথা। দিগন্ত দেখতে কেমন? এটি দেখতে একটি ধনুকের মতো। পুরোটা, তাই না? ঠিক আছে। আরও একটি বিষয়। কিছু তারা আছে… আপনারা জানেন যে তারাগুলো সব এমন ছড়িয়ে থাকে। এগুলো দেখতে বাজে তারা হয়েছে, কিন্তু আমি এর মধ্যে দুটিকে গোল করে দিচ্ছি। এইটা আর এইটা। যখন এই তারাটা এদিকে সরে, তখন এই তারাটাও এদিকে সরে, তাই না? তো, এটা অনেকটা এমন। আপনারা আমার কথা বুঝতে পারছেন?

(অনুবাদে ছবি সংযুক্ত করা হয়নি, তাই উপরের লেখাটি বুঝতে অসুবিধা হতে পারে)

তো, আরবরা যা করত তা হলো—যে তারাটি অস্ত যেতে চলেছে এবং যে তারাটি উদিত হতে চলেছে (কারণ একটি যখন দিগন্তে মিলিয়ে যায়, ঠিক তখনই অন্যটি ফজরের ঠিক আগে দেখা দেয়), এই দুটিকে তারা পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত মনে করত। তারা বলত, এই দুটি ভাই অথবা এই দুটি বোন, অথবা এরা চিরকালের জন্য একে অপরের সাথে সংযুক্ত, যেমন একটি ধনুকের দুটি প্রান্ত। আমার সাথে আছেন তো? এই দুটি তারা সংযুক্ত।

এখন, আমরা কোন তারকাগুচ্ছের কথা বলছিলাম? এর নাম কী ছিল? Pleiades। আর আরবিতে আমরা একে কী বলি? ‘নাজম’। যখন ‘নাজম’ এখানে থাকে, তখন এর সঙ্গী থাকে অন্য প্রান্তে। সেই সঙ্গীর নাম হলো ‘রামী’ (Rami)। আর ইংরেজিতে আমরা একে বলি Sagittarius (স্যাজিটেরিয়াস) বা ধনুরাশি। এটা একটু পরেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ‘রামী’-কে কী বলা হয়? Sagittarius। আর Sagittarius-এর প্রতীক হলো একটি ধনুক ও তীর।

তাহলে এই দুটি মূলত চিরকালের জন্য সংযুক্ত। যখন একটি অস্ত যায়, অন্যটি উদিত হয়। আমার সাথে আছেন তো? আর যখন অন্যটি উদিত হয়, প্রথমটি অস্ত যায়। তারা একসাথে ঘোরে। বেশ, আমরা খুব শীঘ্রই কুরআনের আলোচনায় আসছি। শুধু শেষ একটি তথ্য।

আমি আপনাদের একটু প্রশ্ন করি। শীতকালে ‘নাজম’ কোথায় থাকে? ওপরে। আর এটি রাতভর ভ্রমণ করে পশ্চিম দিকে নিচুতে গিয়ে শেষ হয়। গ্রীষ্মকালে ‘নাজম’ কোথায় থাকে? পূর্ব দিকে। এটি কি দীর্ঘ সময় ধরে থাকে নাকি অল্প সময়ের জন্য? কেন অল্প সময়ের জন্য থাকে? কারণ সূর্য উদিত হতে চলেছে। ‘নাজম’-এর সঙ্গী কোনটি? ‘রামী’, যা হলো ধনুক ও তীরের নক্ষত্রপুঞ্জ। আমার সাথে আছেন?

আচ্ছা, শেষ একটি তথ্য, তারপর আমরা কুরআনে ফিরে যেতে পারব। এই আবার সেই গ্রহ। এই আবার সেই দিগন্ত। আর এই আবার সেই Pleiades, মাথার ওপরে। যদি ‘নাজম’ মাথার ওপরে থাকে, আমি কোন ঋতুর কথা বলছি? শীতকাল। ভালো। বেশ আবেগপূর্ণ উত্তর ছিল।

এরপর আকাশে একটি নক্ষত্রপুঞ্জ আছে যা দেখতে একটি বালতির মতো। আরবরা একে বলত ‘দালউন’ (Dalwun)। ‘দালউন’ মানে হলো কুয়োর বালতি। শীতকালে যখন Pleiades বা ‘নাজম’ এই দিকে চলতে থাকে, তখন এটি ‘দালউন’-এর জায়গা নেয়। আমার সাথে আছেন? এটা আরবদের জন্য একটি সাধারণ দৃশ্য ছিল। তারা বলত, “ওহ, দালউন। ওহ, নাজম। আরে, নাজম তো দালউনের দিকে যাচ্ছে।” তারা এভাবেই কথা বলত। এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল।

বেশ। এবার জিবরীল (আঃ)-এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। প্রথম সাক্ষাৎ পৃথিবীতে হয়েছিল, তাই না? তিনি তাঁকে কোথায় দেখেছিলেন? সর্বোচ্চ দিগন্তে। আমি এমনভাবে কথা বলব যেন আমি প্রাচীন আরবদের সাথে কথা বলছি। আমি ধরে নিচ্ছি আপনারা সবাই প্রাচীন আরব এবং আপনারা আকাশ বোঝেন। তিনি জিবরীলকে সর্বোচ্চ দিগন্তে নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় দেখেছিলেন। إِسْتَوَىٰ (ইস্তাওয়া)। নিখুঁতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ মানে এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়। একেবারে ওপরে। ঠিক যেমন নিখুঁতভাবে আপনারা শীতের মাসগুলোতে ‘আন-নাজম’-কে মাথার ওপরে দেখেন।

এবার, তিনি নেমে এলেন এবং কাছে এলেন। জিবরীল (আঃ) আরও কাছে নেমে আসতে শুরু করলেন। ঠিক যেমন আপনারা Pleiades-কে, যার নাম কী? ‘আন-নাজম’। যেমন Pleiades পশ্চিম দিকে নেমে আসে, আরও কাছে মনে হয়, আর এর কাছে আসা এবং নেমে আসার জন্য আরবি শব্দ হলো إِذَا هَوَىٰ (ইযা হাওয়া)। তো, ঠিক যেমন আরবরা তারকাটিকে নিচে নামতে দেখে, আমি চাই আপনারা জানুন, এটা ততটাই স্পষ্ট ছিল যতটা স্পষ্ট ছিল রাসূল (ﷺ)-এর জিবরীলকে নিচে নামতে দেখা।

এবার, তিনি নিজেকে রাসূল (ﷺ)-এর এত কাছে ঝুলিয়ে দিলেন, تَدَلَّىٰ (তাদাল্লা)। ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ (অতঃপর সে নিকটবর্তী হলো ও ঝুঁকে এলো)। ‘তাদাল্লা’ শব্দটি আরবি শব্দ ‘দালউন’ (Dalwun) থেকে এসেছে। ‘দালউন’ মানে বালতি। আজ কি আপনারা ‘দালউ’ শব্দটি শুনেছেন? ‘দালউ’ কোথায়? সেই বালতির নক্ষত্রপুঞ্জ? আর যখন তারকাগুচ্ছটি নিচে নেমে আসে, তখন কী হয়? এটি ‘দালউ’-তে পৌঁছায়। ঠিক যেমন আপনারা ‘নাজম’-কে ‘দালউ’-তে পৌঁছাতে দেখেন, তেমনি জিবরীল (আঃ) تَدَلَّىٰ (তাদাল্লা), তিনি নিচে নেমে এলেন।

এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে চূড়ান্ত ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। মনে আছে যখন আমি فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ (দু'ধনুকের ব্যবধান) বর্ণনা করেছিলাম? তারা এত কাছে চলে এসেছিলেন। মনে আছে আমি বলেছিলাম, তারা দুটি ধনুক ও তীর একসাথে মিলিয়ে ছুঁড়ত, যার অর্থ—আমরা চিরকালের জন্য এক হয়ে গেলাম। ঠিক যেমন আপনারা জানেন যে দিগন্তের দুই প্রান্তে দুটি তারা একসাথে যুক্ত থাকে, তেমনি আপনাদের জানা উচিত যে মুহাম্মাদ (ﷺ) চিরকালের জন্য জিবরীলের সাথে যুক্ত। তারা একসাথে যুক্ত।

এখন, যে দুটি তারা একসাথে যুক্ত, তাদের কী হয়? একটি যখন অস্ত যায়, অন্যটি… (উদিত হয়)। একটি যখন নিচে নামে, অন্যটি ওপরে ওঠে। তাই তো? যাইহোক, এই সম্পর্কিত দুটি তারকাকে তারা ‘নাও’ এবং ‘রাকীব’ বলত। একটিকে বলা হতো ‘নাও’, অন্যটিকে ‘রাকীব’। যা-ই হোক, জিবরীল (আঃ)-এর অবতরণ মানে হলো রাসূল (ﷺ)-এর উত্থান। আমি আবার বলছি। জিবরীলের নেমে আসা মানে হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উত্থান। তাঁর دُنُوٌّ (দুনু) বা নিকটবর্তী হওয়া মানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর بعثة (বি'ছাত) বা রিসালাতের সূচনা। ঠিক যেমন ‘নাজম’-এর অস্ত যাওয়া মানে হলো ‘রামী’-এর উদয়। আপনারা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

আপনারা কি দেখছেন আল্লাহ কী করছেন? আল্লাহ একটি বাস্তব ঘটনাকে নিচ্ছেন এবং এর মাধ্যমে এক শক্তিশালী আধ্যাত্মিক বাস্তবতাকে বর্ণনা করছেন। ধাপে ধাপে, টুকরো টুকরো করে। তারা আর কখনোই আকাশের দিকে আগের মতো করে তাকাতে পারবে না। তাদের কাছ থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং ওহীর কথা না ভাবার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। একে নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে। আকাশকে ওহীর চিত্রকল্প হিসেবে নতুনভাবে ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে।

চলুন, আরও এগিয়ে যাই। দ্বিতীয়বার। দ্বিতীয়বার জিবরীল (আঃ) উঁচুতে ছিলেন নাকি নিচুতে? তিনি নিচুতে ছিলেন। দ্বিতীয় মৌসুমে, অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে, ‘নাজম’ কোথায় থাকে? নিচুতে, তাই না? জিবরীল (আঃ)-কে তিনি নিচুতে দেখেছিলেন, ঠিক যেমন আপনারা গ্রীষ্মকালে দেখবেন যে ‘নাজম’ দিগন্তের নিচুতে, পূর্ব দিগন্তে থাকবে। এই নিচু দিগন্তের দর্শন ছিল ক্ষণস্থায়ী, যার মানে হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। তাঁকে ফিরে এসে তাঁর মিশন শেষ করতে হয়েছে। ঠিক যেমন আপনারা যখন পূর্ব দিগন্তে ‘নাজম’-কে দেখেন, তখন কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্যই দেখতে পান, কারণ কী আসছে? সূর্য আসছে এবং এটি অদৃশ্য হয়ে যাবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সবচেয়ে দূরের গাছটির দিকে তাকিয়েছিলেন। সেটির নাম কী ছিল? سِدْرَةُ الْمُنْتَهَىٰ (সিদরাতুল মুনতাহা)। ঠিক যেমন আপনারা সবচেয়ে দূরের পূর্ব দিগন্তে ‘নাজম’-কে খুঁজে থাকেন। প্রসঙ্গত, সিরীয় ঐতিহ্যে তারা মনে করত যে স্বর্গ পূর্ব দিকে অবস্থিত, যা বেশ মজার।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে চূড়ান্ত প্রান্তের বৃক্ষের কাছে, চূড়ান্ত আশ্রয়ের বাগানের পাশে দেখেন, তাই না? আর আপনারা দিগন্তে একটি ‘নাজম’ দেখেন এবং আপনারা জানেন যে নতুন জীবন ও সবুজ অঙ্কুরিত হতে চলেছে। এখানের যোগসূত্রটা কী? তিনি (ﷺ) তাঁকে একটি গাছের কাছে দেখেন। আর কী আশ্চর্য, যখন গ্রীষ্ম আসছে, তখন পাতাও আসছে, সবুজ আসছে, জীবন আসছে। ঠিক যেমন আপনারা পূর্ব দিক থেকে ‘নাজম’-এর উদয়কে নতুন জীবনের সাথে যুক্ত করেন, তেমনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিবরীলকে স্থায়ী জীবনের বৃক্ষের কাছে দেখেছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন বা আবৃত হয়ে গিয়েছিল। কীভাবে? মনে আছে, তিনি সিদরা দেখছিলেন এবং জিবরীলকে দেখছিলেন, আর তারপর কী হয়েছিল?
إِذْ يَغْشَى السِّدْرَةَ مَا يَغْشَىٰ
(যখন বৃক্ষটি যা দ্বারা আচ্ছাদিত হবার তা দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল।) [সূরা আন-নাজম ৫৩:১৬]
কোনো কিছু এসে সেটিকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছিল, আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আর যখন আপনি পূর্ব দিকে ‘নাজম’-এর দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন কী হয়? ঠিক এর পেছনে কী আসে? সূর্য।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তবুও সেই আবৃতকারী জিনিসের দিকে তাকাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ যখন সেই নতুন আলো বা তিনি যা-ই দেখে থাকুন না কেন, তা এলো, তখন কি তাঁর চোখ বিচ্যুত হয়েছিল? না। কিন্তু আপনারা, আপনারা তো সূর্যের দিকে তাকাতেও পারেন না। কারণ যখন আপনারা ‘নাজম’-এর দিকে তাকান, তখন বলেন, "ওহ, কী সুন্দর দেখাচ্ছে!" কিন্তু পরক্ষণেই, "ওহ না, ফজর হয়ে গেছে, আমি আর সূর্যের দিকে তাকাতে পারছি না, বড্ড বেশি আলো।" আপনাকে চোখ ফিরিয়ে নিতেই হবে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চোখ ফিরিয়ে নেননি।

আপনারা এই পৃথিবীর একটিমাত্র তারা, যা হলো সূর্য, সেটির দিকেও সরাসরি তাকাতে পারেন না, কারণ এটি খুব কাছে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এই সূর্যের চেয়েও অনেক বড় কিছু দেখেছিলেন, এবং তাঁর চোখ বিচ্যুত হয়নি। (ﷺ)

এটা অনেকটা এমন, যেমন আল্লাহ বলেন, যখন বজ্রপাত হয়, তখন তারা প্রায় আলোর দ্বারা অন্ধ হয়ে যায়। অথবা যখন কেউ ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলে, আপনি বলেন, "আহ!" আপনি এত আলো সহ্য করতে পারেন না। এটাকে বলে ওভারএক্সপোজার। তিনি এটাই বলছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চোখ ওভারএক্সপোজড হতে পারেনি। কারণ তাঁর চোখ আল্লাহ মানুষের জন্য যত চোখ সৃষ্টি করেছেন, তার চেয়েও শক্তিশালী। সেই চোখ এমন কিছু সহ্য করতে সক্ষম যা অন্য কোনো মানুষ পারে না।

প্রথম দর্শনটি চোখ সহ্য করতে পেরেছিল, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল হৃদয়ের শক্তি। এর মানে কী? যখন তিনি রাতে তাঁকে দেখেছিলেন, তিনি জিবরীল (আঃ)-কে দেখতে পেরেছিলেন। এমন নয় যে তিনি তাকাতে পারেননি। তিনি তাকাতে পেরেছিলেন, কিন্তু এটি তাঁর হৃদয়ের জন্য অপ্রতিরোধ্য ছিল। চোখ অভিভূত হয়নি, কিন্তু হৃদয় অভিভূত হতে পারত। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ (সে যা দেখেছে, তার হৃদয় তা অস্বীকার করেনি।) [সূরা আন-নাজম ৫৩:১১]। এটা ছিল প্রথমবার।

কিন্তু দ্বিতীয়বার, এটি আরও কঠিন ছিল। কারণ তাঁকে যা দেখতে হয়েছিল, তা এতটাই অপ্রতিরোধ্য ছিল যে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইত, কিন্তু তাঁর চোখ ফেরায়নি।
مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ
(তার দৃষ্টি বক্রও হয়নি এবং সীমা লঙ্ঘনও করেনি।) [সূরা আন-নাজম ৫৩:১৭]

এই সবকিছুর মূল ফোকাস কী বলে মনে হচ্ছে? আমি আপনাদের পুরোটা পড়ে শোনাই। পরিশেষে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এমন কিছু দেখতে, উপলব্ধি করতে এবং বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন—যার অর্থ رَأَىٰ (রা'আ)—যা অন্য কোনো মানুষ পারেনি। তাঁর (ﷺ) দৃষ্টিশক্তির যে ক্ষমতা ছিল, তার সাথে আপনাদের কোনোভাবেই তুলনা চলে না। আর বিদ্রূপের বিষয় হলো, আপনাদের এই সীমিত দৃষ্টি দিয়ে,
أَفَتُمَارُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ
(তোমরা কি তার সাথে সে যা দেখেছে তা নিয়ে বিতর্ক করবে?) [সূরা আন-নাজম ৫৩:১২]
আপনারা তাঁর দেখা বিষয় নিয়ে সন্দেহ করবেন? আপনারা বলবেন, "ওহ, আমি জানি না সে কী দেখেছে।" আপনারা কি আপনাদের দৃষ্টিশক্তির যোগ্যতার সাথে তাঁর দৃষ্টিশক্তির যোগ্যতার তুলনা জানেন? أَفَتُمَارُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ? না, তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি এমনভাবে দেখেছেন যেমনটি অন্য কোনো মানুষ দেখতে পারে না।

আপনারা সবচেয়ে বড় যা দেখতে পারেন, তা হলো তারা এবং উদীয়মান সূর্য। আর সেটাকেই একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে এমন এক বিশাল কিছু বর্ণনা করার জন্য, যার কাছে এই তারাগুলো কিছুই নয়। প্রকৃতপক্ষে, আসমান ও জমিন এক ক্ষুদ্র বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। জিবরীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দেখা বিষয়ের তুলনায় দিগন্তের একটি তারার মতো হয়ে গিয়েছিলেন।

আল্লাহ অন্যত্র বলেন, আল্লাহ ক্ষুদ্রতম উদাহরণ দিতেও লজ্জা বোধ করেন না। এই ক্ষেত্রে, তারা এবং সূর্য সবচেয়ে ক্ষুদ্র উদাহরণে পরিণত হয়েছে এমন এক বিশাল কিছু বর্ণনা করার জন্য। سُبْحَانَ اللهِ!

مَا زَاغَ الْبَصَرُ وَمَا طَغَىٰ لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ

আসুন, এই দুনিয়াতে ফিরে আসি। যখন জিবরীল (আঃ) তাঁকে এই সফরে নিয়ে গেলেন এবং তিনি ফিরে এলেন, তখন কাফেররা বলল, "ওহ, আমাদের এটা বিশ্বাস করতে হবে? আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে সে এটা দেখেছে?" আর আপনারা যখন তাঁর দৃষ্টি ও তাঁর দেখাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, তখন আল্লাহ যেভাবে জবাব দেন, তা হলো—তিনি এমনভাবে দেখেন যেমন কোনো মানুষ কখনো দেখেনি এবং তিনি এমনভাবে বোঝেন—কারণ 'দেখা' মানে 'বোঝা'ও হয়, তাই না?—যেমন কোনো মানুষ কখনো বুঝতে পারেনি। আপনাদের প্রশ্ন করার কোনো যোগ্যতাই নেই।

অল্প কথায় এতগুলো মহাজাগতিক ঘটনা, এতকিছু যা আকাশে ঘটছে, তার সবকিছুকে শুধু এই একটি বাক্যে ধারণ করা হয়েছে: وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ। শুধু এইটুকু। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর পুরো অভিজ্ঞতাকে আকাশের বুকে ঘটে চলা ঘটনার ওপর স্থাপন করা হয়েছে। আমি আপনাদের বলেছিলাম কুরআনের একটি মূলনীতি হলো, এখানে একটি বাস্তব ঘটনাকে এক আধ্যাত্মিক সত্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়। আমি আশা করি আপনারা তার একটি বাস্তব উদাহরণ দেখতে পেয়েছেন।