সুরা আন নাজম (পর্বঃ১৩)

Spread the love

এখানে আধ্যাত্মিক অর্থ আর বাহ্যিক অর্থকে একসাথে তুলে ধরা হয়েছে। এটা এমন এক জগৎ যেখানে আধ্যাত্মিকতা আর বাস্তবতা একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তাই, এখানে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, তা আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক—দুই অর্থকেই একসাথে ধারণ করে। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!

আমি আবার জান্নাতুল মা'ওয়া (Jannatul Ma'wa)-এর আলোচনায় ফিরে আসি এবং আপনাদের সাথে আরও কিছু বিষয় শেয়ার করি। জান্নাতকে ‘জান্নাতুল খুলদ’ (jannatul khuld) বা অনন্তকালের বাগান বলেও বর্ণনা করা যেতে পারে। অথবা শুধু ‘আল-জান্নাহ’ (al jannah), অর্থাৎ বাগান বললেও আমরা বুঝে যাই। কিন্তু এখানে জান্নাতের সাথে যে বিশেষণটি যোগ করা হয়েছে, তা হলো ‘জান্নাতুল মা'ওয়া’ (jannatul ma'wa) অর্থাৎ, চূড়ান্ত আশ্রয়ের জান্নাত। আমরা কিন্তু এর অর্থ কী হতে পারে, তা নিয়ে খুব বেশি ভাবার সময় পাইনি।

এখানে একটি তুলনা তুলে ধরা হচ্ছে। এই যে জীবন, যেটা আপনি আর আমি এখন যাপন করছি, এতেও অনেক ‘জান্নাত’ থাকতে পারে। আল্লাহ সূরা আল-কাহফে এমন এক ব্যক্তির কথা বলেছেন, যার দুটি জান্নাত ছিল, ‘জান্নাতাইন’ (jannatayn)। "كِلْتَا الْجَنَّتَيْنِ آتَتْ أُكُلَهَا" (দুটি বাগানই পরিপূর্ণ ফল দান করেছিল) [সূরা আল-কাহফ ১৮:৩৩]।

সূরা আল-বাকারাহ-তে আল্লাহ বলেন,
"أَيَوَدُّ أَحَدُكُمْ أَن تَكُونَ لَهُ جَنَّةٌ مِّن نَّخِيلٍ وَأَعْنَابٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ لَهُ فِيهَا مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ"
(তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে যে তার একটি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান থাকবে, যার তলদেশ দিয়ে নহর প্রবাহিত হয়, যেখানে তার জন্য সব রকমের ফলমূল থাকবে?) [সূরা আল-বাকারাহ ২:২৬৬]।

আপনাদের মধ্যে যাদের হাতে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা আছে… কোভিড-এর সময় টেক্সাসে কনস্ট্রাকশনের খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে বাড়ির পেছনের আঙিনা নতুন করে সাজানোর খরচ, কারণ মানুষ তাদের বাড়ির পেছনের আঙিনায় নিজেদের ‘জান্নাত’ আপগ্রেড করছিল, তাই না? তারা তাদের বাগান তৈরির পেছনে সময় খরচ করছিল।

আমি যখন মাঝে মাঝে সফরে যাই, তখন কিছু মানুষ থাকেন যারা বেশ প্রভাবশালী (high-rollers)। তারা আমার সাথে দেখা করতে চান, কথা বলতে চান। আমি ভাবি, "ঠিক আছে, আপনার ঐ বিলাসবহুল জায়গাতেই নাহয় দুপুরের খাবার খাবো।" আপনি তাদের বাড়িতে যাবেন আর দেখবেন, বিশাল গেট, নিরাপত্তা প্রহরী, এসব পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে হবে। তাদের একটা বাড়ি আছে, কিন্তু সেই বাড়িটাই মূল আকর্ষণ নয়। একটা সুন্দর বাড়ি তো আপনি যেকোনো জায়গাতেই বানাতে পারেন। মূল আকর্ষণ হলো তাদের বিশাল বাগান, উঁচু দেয়াল, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা… দেখবেন তাদের নাতি-নাতনিরা চারপাশে দৌড়াচ্ছে, পানির ফোয়ারা চলছে—এককথায়, একটা জান্নাত। এটা একটা জান্নাত।

আর এটা এমন একটা জিনিস, যা মানুষ তার হৃদয়ের গভীর থেকে আকাঙ্ক্ষা করে। আমরা ছুটি কাটাতে এমন সব জায়গায় যাই, যা দেখতে জান্নাতের মতো। আমরা আমাদের বাড়ির পেছনের আঙিনায় এক ধরনের জান্নাতি পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করি। আর যদি পুরো একটা জান্নাত বানানো সম্ভব না-ও হয়, তাহলে আমাদের অফিসের মনমরা কিউবিকলে অন্তত একটা ছোট্ট জান্নাতি গাছ রাখি। আপনার মা যদি আমার দেশের দিকের হন, তাহলে দেখবেন, গাছের কারণে ঘরে পোকামাকড় আসার ভয়ে যদি বেশি গাছ রাখতে না পারেন, তাহলে ঘরে প্লাস্টিকের জান্নাত সাজিয়ে রাখেন—প্লাস্টিকের ফুল, প্লাস্টিকের পাতা। অন্তত দেখতে যেন সবুজ লাগে! মানুষের মধ্যে এই সবুজ শ্যামলিমার প্রতি একটা টান আছে।

যাইহোক, ‘জান্নাত’ (jannah) শব্দের অর্থ হলো ‘ঢেকে রাখা’। ঘন সবুজ গাছপালা যা মাটিকে ঢেকে রাখে। ‘জিন’দেরকে (jinn) জিন বলা হয় কারণ তারা আমাদের দৃষ্টি থেকে ঢাকা বা আড়াল থাকে। মায়ের গর্ভের শিশুকে ‘জানিন’ (janin) বলা হয়, কারণ সে লুকানো বা ঢাকা অবস্থায় থাকে। তাই যে জমিনের মাটি সবুজ গাছপালা, ফুল আর সৌন্দর্যে ঢাকা থাকে, তাকে ‘জান্নাত’ বলা হয়।

আমি যে কথাটা বলছিলাম, তা হলো—এই জীবনে আপনার জান্নাত থাকতে পারে, কিন্তু তা কখনোই আপনার জন্য আশ্রয়স্থল হবে না। এই দুনিয়াতে আপনার সুন্দর জিনিস থাকতে পারে, টাকা-পয়সা থাকতে পারে, সুন্দর একটা বাড়ি থাকতে পারে, সুন্দর পরিবার থাকতে পারে—এই সবকিছুই আপনার থাকতে পারে। কিন্তু এটা কখনোই নিরাপদ নয়। এটা কখনোই স্থায়ীভাবে সুরক্ষিত নয়। আর এই দুনিয়ার কোনো কিছুর মধ্যে আপনি যত বেশি নিরাপত্তা খুঁজবেন, তত বেশি আপনি নিজেকে দুঃখ-কষ্টের জন্য প্রস্তুত করবেন। আপনি নিজেকে শুধু কষ্টের দিকেই ঠেলে দিচ্ছেন।

মানুষ বলে না, ‘আহ্, তুমি না থাকলে আমি কী করতাম জানি না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবই না।’ আরে, আপনি ঠিকই বেঁচে থাকবেন। সাহাবারাও তো রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর বেঁচে ছিলেন, আপনিও ভালোভাবেই থাকবেন। আপনার ভালোবাসা অতটাও নাটকীয় নয়। ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ হ্যাঁ, আপনি পারছেন। বাতাসে এখনো অক্সিজেন আছে, আপনার নাক এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে, আপনার ফুসফুস এখনো প্রসারিত হচ্ছে। এগুলো বলার জন্য বলা কিছু নাটকীয় কথা মাত্র।

কিন্তু মূল বিষয় হলো, কিছু মানুষ নির্ভরতা তৈরি করে—টাকার ওপর নির্ভরতা, সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরতা। এমন অনেক মানুষ আছে যারা একসময় খুব সুন্দর দেখতে ছিল, তাদের সৌন্দর্যের জন্য তারা বিখ্যাত ছিল। তারপর তারা বয়স্ক হয়ে গেল, তাদের সৌন্দর্য চলে গেল, আর এখন তারা হতাশ, এমনকি আত্মহত্যার কথাও ভাবে। এসব কিছুর কারণ হলো, তাদের আশ্রয় ছিল তাদের সৌন্দর্য। কারো আশ্রয় ছিল তার বাগান, কারো আশ্রয় ছিল তার টাকা, কারো আশ্রয় ছিল তার খ্যাতি। আমাদের সবারই এমন ভিন্ন ভিন্ন আশ্রয়স্থল আছে, যা আমাদের নিরাপদ বোধ করায়।

মনোবিজ্ঞানে আমি সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করেছি, তার একটি হলো নিরাপত্তার প্রতি মানুষের তীব্র চাহিদা (the human need for safety)। এই চাহিদা যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের যেমন আছে, তেমনি বিলিয়নিয়ারদেরও আছে। বিখ্যাত ব্যক্তিরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষদের মধ্যে অন্যতম। আপনার মনে হতে পারে, তাদের চারপাশে সবসময় মানুষ থাকে, কিন্তু তারা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না। ‘এই লোকগুলো কি আমার কাছে শুধু আমার খ্যাতির জন্য আসে? তারা কি আমাকে শুধু আমার তারকাখ্যাতির পরিচয়েই চেনে? তারা যদি আসল আমাকে চিনতো, আমি কি তাদের কাছে নিরাপদ থাকতাম? নাকি তারা আমার সব গোপন কথা দুনিয়ার কাছে ফাঁস করে দিত? এই দেখো, এই বিখ্যাত লোকটা সম্পর্কে আমি কী জানি!’ তারা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

তাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি হলো এমন কাউকে খুঁজে বের করা, যার সাথে তারা নিরাপদ থাকতে পারে। তাদের কোনো ‘মা'ওয়া’ (ma'wa) বা আশ্রয় নেই। তাদের হয়তো সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি আছে, নিরাপত্তা প্রহরী আছে, সবকিছু আছে, কিন্তু তাদের এমন কেউ নেই যার সাথে তারা মন খুলে কথা বলতে পারে। তাদের কোনো ‘মা'ওয়া’ নেই।

ধরুন, কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে বিশ্বাস করলেন। আর পরদিনই দেখা গেল, তার সেই বন্ধুই মিডিয়ার কাছে কোনো তথ্য ফাঁস করে দিল আর প্রেসিডেন্টের নির্বাচনী প্রচারণাকে ধ্বংস করে দিল। এমন কি হয়? হ্যাঁ, হয়। কারণ যে লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে তার কাছে সব ধরনের নিরাপত্তা আছে, আসলে তার কোনো নিরাপত্তাই নেই। সে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই বাস করছে।

কুরআনে বর্ণিত সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষদের একজন হলো ফেরাউন, আপনারা তো জানেন, তাই না? প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী। আপনারা জানেন আল্লাহ ফেরাউন সম্পর্কে কী বলেন? আল্লাহ বলেন, আমরা ফেরাউন ও তার সেনাবাহিনীকে সেটাই দেখিয়ে ছাড়ব, যা নিয়ে তারা শঙ্কিত ছিল। কী আশ্চর্য! তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাসাদে থাকো, তোমার বানানো স্মৃতিস্তম্ভগুলো আজও পৃথিবীতে টিকে আছে, আর তুমি কি না ভয় পাও?

মানুষের জন্য এই দুনিয়াতে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো চূড়ান্ত নিরাপত্তা নেই। আল্লাহ বলছেন, মানুষ নিরাপত্তা আর সুরক্ষা খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষ কঠোর পরিশ্রম করছে। আমি এমন অনেক মানুষকে চিনি, যারা খুব ছোট অ্যাপার্টমেন্টে থাকে, খুব কষ্টের জীবন যাপন করে, কারণ তারা শুধু টাকা জমাচ্ছে, জমাচ্ছে, আর জমাচ্ছে। কারণ তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ১০ বছর পর আর্থিক নিরাপত্তা অর্জন করা। আর এর জন্য তারা এখন থেকেই কাজ করে যাচ্ছে। এই দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনা—এসবই হলো ‘মা'ওয়া’ (ma’wa) বা আশ্রয়ের অনুসন্ধান। এটাই আপনি চান। তারা এটাকে ‘সেফটি নেট’ (safety net) বলে। ‘গোল্ডেন প্যারাসুট’ (the golden parachute)—এরকমই তো বলে, তাই না? আধুনিক পৃথিবীর এই সব পরিভাষাগুলো আসলে ‘মা'ওয়া’ (ma’wa)-এরই ভিন্ন নাম।

মানুষ থেরাপিস্টের কাছে যায়। ‘আমি উদ্বিগ্ন বোধ করি। আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। আমি নার্ভাস থাকি। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না।’—এগুলো সবই হলো, ‘আমার মা'ওয়া-সংক্রান্ত সমস্যা আছে’ (I have ma’wa issues)।

আর আল্লাহ বলছেন, ‘ইন্দাহু জান্নাতুল মা'ওয়া’,আমি এখানে ব্যাকরণের (nahu) দৃষ্টিকোণ থেকে বলিনি, কারণ এখানে 'ইন্দাহু' শব্দটি আগে এসেছে, যার অর্থ দাঁড়ায়, "কেবল তাঁর কাছেই রয়েছে চূড়ান্ত আশ্রয়ের জান্নাত।" অন্য কথায়, চূড়ান্ত আশ্রয় আর কোনো বাগানে, আর কোনো সুন্দর জিনিসে পাওয়া সম্ভব নয়। কোনো কিছু সুন্দর হতে পারে, কিন্তু নিরাপদ হতে পারে না।

সম্প্রতি আমার এক সফরে আমি এক তরুণীর সাথে দেখা করি। আমি এক টিভি প্রযোজকের সাথে কথা বলছিলাম… আমরা পুরোনো বন্ধু… এমন একটি দেশে, যার নাম বলা যাবে না, আর মানুষগুলোর নামও বলা যাবে না। তো, সেই মেয়েটি একজন অভিনেত্রী বা ঐরকম কিছু ছিল, তার দেশে খুব বিখ্যাত। সে বলল, "আমি আপনার অনেক ভিডিও দেখি।" আমি বললাম, "খুব ভালো।" কারণ সে স্টুডিওতে ঢোকার পর আমাদের কথা শুরু হয়েছিল।

কথাবার্তার কিছুক্ষণ পর সে আমাকে বলল, তার শো হিট হয়েছে, সে নতুন চুক্তি পেয়েছে, সে আগের চেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত হয়ে গেছে, তার সিনেমা অনেক পুরস্কার পেয়েছে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর তারপরেই সে বলতে শুরু করল, "আমি কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?"
আমি বললাম, "কী?"
"যখন আপনার মনে হয় আপনি কোথাও নিরাপদ নন, এবং আপনি শুধু নিজের জীবনটা শেষ করে দিতে চান… তখন কী করার আছে?"

আমি ভাবছিলাম, ‘লাখ লাখ তরুণী তোমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ইশ! আমি যদি তোমার মতো হতে পারতাম!” আর এদিকে তুমি, বেচারি, বলছ, “ইশ! আমি যদি মরে যেতে পারতাম!”’

সে নিরাপদ নয়। লক্ষ লক্ষ ভক্তের মাঝে থেকেও সে নিরাপদ নয়। তারা সবাই তার মতো হতে চায়। কিন্তু তার কোনো ‘মা'ওয়া’ (ma'wa) নেই। আল্লাহ যখন বলেন ‘ইন্দাহু জান্নাতুল মা'ওয়া’, তিনি আমাদের এক গভীর সত্য জানিয়ে দেন। আমরা আর কোথাও নিরাপত্তা খুঁজতে পারি না। তা কেবল আল্লাহর কাছেই আছে।

আশ্রয়ের ব্যাপারে আরেকটি বিষয় হলো… যেমন সূরা আল-কাহফে বলা হয়েছে, "গুহায় আশ্রয় নাও"। নূহ (আঃ)-এর ছেলে বলেছিল," (আমি কোনো পাহাড়ে আশ্রয় নেব, যা আমাকে পানি থেকে রক্ষা করবে)। এটা ছিল আশ্রয় গ্রহণ। আশ্রয় তো তখনই নেওয়া হয়, যখন আপনি কোনো নেতিবাচক কিছু থেকে পালাতে চান, তাই না? আপনি কোনো নেতিবাচক কিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। জান্নাত হবে প্রথম সেই জায়গা, যেখানে আমরা সত্যিই সমস্ত নেতিবাচক জিনিস থেকে দূরে থাকব—চূড়ান্ত আশ্রয়।

কিন্তু শুধু নেতিবাচকতা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কথা বললেই তো আর কোনো ইতিবাচক কিছুর কথা বলা হলো না। ঠিক আছে, সমস্যাগুলো চলে গেল, আমরা নিরাপদ। এটাই ‘জান্নাতুল মা'ওয়া’ (Jannatul ma'wah)। কিন্তু এর চেয়েও বড় কিছু কি আছে?

হ্যাঁ, ‘জান্নাত’ (jannah) শব্দটির মধ্যেই গাছ, ছায়া, ফল, সৌন্দর্য—এসব কিছু অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু এরপর আল্লাহ বলছেন, সেই গাছ এবং সবকিছু আরও বড় কিছু দ্বারা আবৃত হয়ে যায়। আর সেই ‘আরও কিছু’ হলো আমাদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি (রিদা)।

এমনকি জান্নাতের শুরুতে আমরা খাবার, পানীয়, সঙ্গ—এসব কিছু পাবো। কিন্তু সেগুলো জান্নাতের চূড়ান্ত পুরস্কার নয়। চূড়ান্ত পুরস্কার হলো:
"سَلَامٌ قَوْلًا مِّن رَّبٍّ رَّحِيمٍ"
(পরম দয়ালু রবের পক্ষ থেকে ‘সালাম’ বলা হবে।) [সূরা ইয়াসিন ৩৬:৫৮]
আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ, স্বয়ং আল্লাহ আপনাকে সালাম দিচ্ছেন—এটাই চূড়ান্ত পুরস্কার।
"وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَّاضِرَةٌ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ"
(সেদিন কতক মুখমণ্ডল হবে উজ্জ্বল, তারা তাদের রবের দিকে তাকিয়ে থাকবে।) [সূরা আল-কিয়ামাহ ৭৫:২২-২৩]
এটাই হলো পরম পুরস্কার।

এবার এই বিষয়টি জান্নাতের প্রেক্ষাপটে না ভেবে দুনিয়ার প্রেক্ষাপটে ভাবুন। আমরা যখন গুনাহ করি—এবং আমরা সবাই গুনাহ করি—তখন শুরুতে আমরা শাস্তির ভয়ে থাকি, তাই না? কারণ গুনাহ শাস্তিযোগ্য, আমরা চাই না কিয়ামতের দিন আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক, আমাদের বিরুদ্ধে তা লেখা থাকুক, আর জাহান্নামের শাস্তি হোক।

কিন্তু আপনারা জানেন কি, গুনাহ আরও একটি কাজ করে যা শাস্তির চেয়েও অনেক বেশি দামী, অনেক বেশি ক্ষতিকর? গুনাহ আমার অন্তরকে কঠিন করে দেয়, আর আমি আমার অন্তরে আল্লাহর উপস্থিতি ততটা তীব্রভাবে অনুভব করতে পারি না, যতটা আগে পারতাম। গুনাহ আমাকে অনুভূতিহীন করে দিচ্ছে। এটা অনেকটা অ্যানেসথেসিয়া নেওয়ার মতো, যার পরে আপনি আর কিছু অনুভব করতে পারেন না। এখন আমি গুনাহ করছি আর সালাতে দাঁড়িয়ে কিছুই অনুভব করতে পারছি না। আমি গুনাহ করছি আর দুআ করছি, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না। আমি গুনাহ করছি আর কুরআন তিলাওয়াত করছি, কিন্তু কিছুই অনুভব করছি না। আর এটাই হলো স্বয়ং আল্লাহ থেকে দূরত্ব, আল্লাহ থেকে দূরত্ব।

আর আপনি যদি এটা উপলব্ধি করতে পারেন, তাহলে গুনাহর সাথে আপনার সম্পর্ক বদলে যাবে। আপনি ভাববেন, ‘আমি এটা হারাতে পারি না।’ আপনি যদি জীবনে একবারও সেই অনুভূতি পেয়ে থাকেন… আপনার জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত নিশ্চয়ই এসেছে যখন আপনি আল্লাহর সাথে এমন এক নৈকট্য অনুভব করেছেন যা আগে কখনো করেননি। সম্ভবত এই মুহূর্তেও আপনি সেই মুহূর্তটা মনে করতে পারছেন—আপনি কোথায় ছিলেন, আপনার চোখে কী ছিল, কোন কান্না আপনি অনুভব করেছিলেন। সেই মুহূর্তটা আপনার হৃদয়ে গেঁথে আছে। সত্যি বলতে, আপনি যার প্রেমে পড়েছিলেন সেই মুহূর্ত, বা প্রথমবারের মতো আপনার সন্তানকে দেখার মুহূর্ত, বা আপনার বিয়ের দিনের স্মৃতিগুলোও ঝাপসা হয়ে গেছে। আপনি হয়তো ভাববেন, ‘মনে আছে আমাদের কেমন লেগেছিল?’ ‘আসলে ঠিক মনে নেই।’ ‘আমার জন্মের সময়টা মনে আছে?’ ‘হ্যাঁ, হাসপাতালের কথা মনে আছে।’ আপনি সেই অনুভূতিটা মনে করতে পারেন না।

কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য লাভের সেই অনুভূতি… ওহ! হয়তো আপনি গত রমজানে তা অনুভব করেছেন, হয়তো উমরাহ করার সময় অনুভব করেছেন, হয়তো কোথাও কোনো খুতবা শোনার সময় অনুভব করেছেন। সেই অনুভূতিটাই হলো আল্লাহর সাথে চূড়ান্ত নৈকট্য। এটা এমনকি জান্নাতের আকাঙ্ক্ষাকেও ছাড়িয়ে যায়। কারণ এর মধ্যে এমন এক নেয়ামত আছে, এমন এক প্রশান্তি আছে, যার সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।