ذُو مِرَّةٍ فَاسْتَوَىٰ (যিনি শক্তিশালী, অতঃপর তিনি নিজ আকৃতিতে স্থির হয়েছিলেন)। فَاسْتَوَىٰ মানে হলো তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, স্থির হলেন। الإِسْتِوَاء মানে হলো কোনো কিছু একদম সমান বা সোজা হয়ে দাঁড়ানো। যেমন কুরআনে বলা হয়েছে فَاسْتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِ (ফাসতাওয়া ‘আলা সূকিহি) যখন কোনো চারাগাছ তার কাণ্ডের ওপর দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে فَاسْتَوَىٰ أَيْ فَاسْتَقَامَ عَلَىٰ صُورَتِهِ الْحَقِيقِيَةِ الَّتِي خَلَقَهُ اللَّهُ تَعَالَىٰ عَلَيْهَا (অর্থাৎ তিনি তাঁর সেই আসল আকৃতিতে স্থির হলেন, যে রূপে আল্লাহ তাঁকে সৃষ্টি করেছেন)। এর মানে হলো, জিবরীল (আঃ) তাঁর আসল রূপে, যে রূপে আল্লাহ তাঁকে সৃষ্টি করেছেন, সেভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কারণ জিবরীল (আঃ) যখন হেরা গুহায় নবী ﷺ-এর কাছে এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁর আসল আকৃতিতে ছিলেন না। কারণ তাঁকে গুহার ভেতরে জায়গা করে নিতে হয়েছিল। কিন্তু এখন আল্লাহ এমন একটি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন, যেখানে জিবরীল (আঃ) তাঁর আসল, পূর্ণাঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সম্পূর্ণ রূপে। আর এটা ছিল নবুয়তের প্রাথমিক পর্যায়ে হেরা গুহার কাছে।
এই ঘটনাটি কখন ঘটেছিল, তা নিয়ে মতভেদ আছে। আমার কাছে বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয় যে, সূরা ইকরার আয়াতগুলো নাযিল হওয়ার পর এটি ছিল দ্বিতীয় সাক্ষাৎ। মাঝখানে কিছুদিন ওহী আসা বন্ধ ছিল, আর তারপর রাসূল ﷺ তাঁকে আবার দেখতে পান। আর যখন তিনি তাঁকে আবার দেখলেন, তখন জিবরীল (আঃ) পুরো আকাশ জুড়ে বিস্তৃত ছিলেন। আর তখনই তিনি দৌড়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন আমাকে চাদর দিয়ে ঢেকে দাও… সেই ঘটনাটি ঘটেছিল। বর্ণনায় কিছু পার্থক্য থাকলেও আমার কাছে মনে হয়, এই সময়েই তিনি পূর্ণরূপে দর্শন লাভ করেছিলেন। প্রথম সাক্ষাতের সময় নয়, যখন إِقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ (পড়ো তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন) নাযিল হয়েছিল। কারণ তখন তিনি فَاسْتَوَىٰ (নিজ রূপে স্থির) ছিলেন না, আর দিগন্তেও ছিলেন না।
যাইহোক, এরপর বলা হচ্ছে, তাঁর ছয়শত ডানা ছিল। আর প্রতিটি ডানা দিগন্তের পর দিগন্ত ঢেকে রেখেছিল। যখন তিনি তাঁর আসল রূপ ধারণ করলেন, তখন তাঁর ডানাগুলো পুরো আকাশকে ঢেকে ফেলেছিল।
তো, এখন আল্লাহ বর্ণনা করবেন যে নবী ﷺ কীভাবে জিবরীল (আঃ)-কে দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। আল্লাহ আগেই তাঁর শক্তি, তাঁর দ্রুত চলার ক্ষমতার কথা বলেছেন। আর এখন সেই শক্তিশালী ফেরেশতার সাথে সাক্ষাৎ, তাঁকে দেখার মুহূর্তটির বর্ণনা দিচ্ছেন।
যখন তিনি তাঁর আসল রূপ ধারণ করলেন, وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَىٰ (আর তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বদিগন্তে)। الأفق الأعلى (আল-উফুকিল আ'লা) মানে হতে পারে একদম মাথার ওপরের আকাশ। কেউ কেউ বলেন এর মানে ডান দিকের আকাশ, কিন্তু আসলে সবচেয়ে পরিষ্কার আকাশ হলো সেটাই, যা ঠিক আপনার মাথার উপরে থাকে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর বা দক্ষিণে আপনার দৃষ্টিতে কোনো না কোনো বাধা আসতে পারে—বড় বিল্ডিং, গাছপালা বা পাহাড়। কিন্তু যে আকাশটি একদমই বাধাহীন, তা হলো আপনার ঠিক মাথার ওপরের আকাশ, الأفق الأعلى।
একবার কল্পনা করার চেষ্টা করুন, রাসূল ﷺ ওপরের দিকে তাকাচ্ছেন আর দেখছেন যে পুরো দিগন্ত এই বিশাল, মহিমান্বিত সত্তা দ্বারা আবৃত হয়ে গেছে। আর তিনি তাঁকে চিনতে পারছেন।
তো, وَهُوَ بِالْأُفُقِ الْأَعْلَىٰ (আর তিনি ছিলেন ঊর্ধ্বদিগন্তে)। ثُمَّ دَنَا (অতঃপর তিনি নিকটবর্তী হলেন)। তিনি নিচে নামতে শুরু করলেন। এবার ভাবুন তো, সেই মুহূর্তে ভয়ের বা সম্ভ্রমের মাত্রাটা কেমন হতে পারে? জিবরীল (আঃ) নিচে নামতে শুরু করলেন। এরপর আল্লাহ বলেন, فَتَدَلَّىٰ (ফাতাদাল্লা)। تَدَلَّىٰ (তাদাল্লা) এর আসল মানে হলো, তিনি নিচে এসে ঝুঁকে পড়লেন বা ঝুলতে লাগলেন।
تَدَلَّىٰ শব্দটি আরবি دَلْوٌ (দালউন) থেকে এসেছে। এর মানে হলো কুয়া থেকে পানি তোলার বালতি। যে বালতির সাথে দড়ি বাঁধা থাকে। কী অদ্ভুত সুন্দর মিল, তাই না? আবার সেই দড়ির উপমা ফিরে আসছে! তো, তিনি একটি দড়িতে ঝোলানো বালতির মতো ঝুলছিলেন। বালতির ব্যাপারটা কী? তাকে তো ওপর থেকে কিছু একটা ধরে রাখে, তাই না? এই চিত্রকল্পটা যেন এমনভাবে ফুটিয়ে তুলছে যে, জিবরীল (আঃ) শূন্যে ঝুলছেন আর স্বয়ং আল্লাহ তাঁকে ধরে রেখেছেন। যেমন আল্লাহ আকাশে উড়ন্ত পাখিদের সম্পর্কে বলেন, مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا الرَّحْمَٰنُ (পরম করুণাময় ছাড়া আর কেউই তাদেরকে ধরে রাখে না)। এখানেও জিবরীল (আঃ)-কে যেন পরম করুণাময় আল্লাহই শূন্যে ধরে রেখেছেন। কী অসাধারণ ভাষা!
আমীন আহসান ইসলাহী তাঁর তাফসীর 'তাদাব্বুরে কুরআন'-এ এ বিষয়ে খুব সুন্দর একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এটা ঠিক তেমন, যেমন একজন শিক্ষক স্নেহভরে তাঁর ছাত্রের দিকে ঝুঁকে আসেন তার কাজ দেখার জন্য, বা তাকে কিছু শেখানোর জন্য, বা তার কানে কানে এমন কিছু বলার জন্য যা তিনি চান না অন্য কেউ শুনুক। تَدَلَّىٰ (তাদাল্লা) – তিনি ঝুঁকে এলেন। নবী ﷺ-এর সাথে এই ঘনিষ্ঠতাকে এই শব্দগুলোর মাধ্যমে বর্ণনা করা হচ্ছে।
এরপর, فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ (অতঃপর তাঁর এবং নবীর মধ্যে দুই ধনুক পরিমাণ ব্যবধান রইল)। এইখানেই আসল সৌন্দর্যটা লুকিয়ে আছে। তিনি এত কাছে এসেছিলেন যে ব্যবধান ছিল ধনুকের দুই মাথার। এটা ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন হবে, আমাকে একটু সময় দিন। আপনারা সবাই তো তীর-ধনুক চেনেন, তাই না?
قَابَ قَوْسَيْنِ (ক্ব-বা ক্বওসাইন) এর দুটো অর্থ হতে পারে। দুটোই তীর-ধনুকের সাথে সম্পর্কিত।
একটা অর্থ হলো—ধনুকটা দেখতে ইংরেজি 'D' অক্ষরের মতো, তাই না? এই ধনুকের বাঁকানো অংশের অর্ধেককে বলা হয় قاب (ক্বব)। আর বাকি অর্ধেক হলো আরেকটা قاب (ক্বব)। মাঝখানে থাকে হাতল বা ধরার জায়গা। তো, যখন আপনি ধনুকটা ধরেন, তখন একদিকের অংশটা একটা قاب (ক্বাব) আর অন্যদিকের অংশটা আরেকটা قاب (ক্বাব)। বুঝতে পারছেন? এটা হলো قاب (ক্বাব) শব্দের একটা অর্থ।
আরেকটা অর্থ বুঝতে হলে, আবার সেই ধনুকের কথা ভাবুন। ধনুকের একটা বাঁকানো অংশ থাকে, আর একটা সোজা ছিলা বা দড়ি থাকে। এবার কল্পনা করুন, ধনুকের ঠিক মাঝখানের হাতল আর ছিলার মাঝখানের যে দূরত্ব—সেই দূরত্বটুকুকেও قاب (ক্বব) বলা হয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দ্বিতীয় অর্থটির দিকেই বেশি ঝুঁকেছি, এবং অনেক আলেমও এই মতটিকেই প্রাধান্য দেন। আল্লাহ এখন বর্ণনা করছেন, জিবরীল (আঃ) নবী ﷺ-এর কতটা কাছে এসেছিলেন—ধনুকের হাতল আর ছিলার মাঝখানের দূরত্বের মতো। জিবরীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ঠিক ততটাই কাছে এসেছিলেন।
আরবরা এই শব্দটি ব্যবহার করতো এমন মানুষদের জন্য, যারা একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ। তারা বলতো, "আরে, ওরা দুজন তো قاب قوسين (ক্ব-বা ক্বওসাইন)-এর মতো," মানে তারা খুবই কাছের। আল্লাহ বলছেন, তিনি নবীর অবিশ্বাস্যরকম কাছে চলে এসেছিলেন।
কিন্তু এরপর তিনি বলেন, أَوْ أَدْنَىٰ (আও আদনা) – "অথবা তার চেয়েও কাছে।" এর মানে, সেই ঘনিষ্ঠতাও যথেষ্ট ছিল না, তিনি ছিলেন তার থেকেও বেশি কাছে ছিলেন। এটা জিবরীল (আঃ) এবং আল্লাহর রাসূল ﷺ-এর মধ্যেকার এক গভীর সম্পর্ককে তুলে ধরছে।
এবং এই সম্পর্কটা কোনো ভয়ের সম্পর্ক নয়। কারণ যখন আপনি আয়াতগুলো প্রথম পড়বেন—শক্তিশালী, দিগন্তজোড়া, ক্ষমতাধর, ঊর্ধ্বাকাশে—তখন একটা সম্ভ্রম জাগে। তিনি তাঁর পূর্ণ আকৃতি ধারণ করেছিলেন, কিন্তু এখন তিনি নবী ﷺ-এর এতটা কাছে। আর আল্লাহ বলছেন, এমনকি সেটাও যথেষ্ট কাছে নয়। أَوْ أَدْنَىٰ (আও আদনা) – "অথবা তার চেয়েও কাছে।"
এই ঘনিষ্ঠতা এজন্যও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ وحي (ওয়াহী) শব্দের একটা অর্থ হলো, কারো কানে এমনভাবে কিছু বলা, যা অন্য কেউ শুনতে পায় না। তাই জিবরীল (আঃ) রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর কতটা কাছে ছিলেন, তা বর্ণনা করা জরুরি ছিল, যাতে বোঝা যায় যে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন কেবল তিনি আর রাসূলুল্লাহ ﷺ-ই ছিলেন। বুঝতে পারছেন?
তো এটা ছিল জিবরীল (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাতের ঘটনা। কিন্তু এখন আমরা قَابَ قَوْسَيْنِ (ক্ব-বা ক্বওসাইন) নিয়ে আরেকটু গভীরে যাবো, আর এখান থেকে আপনারা অসাধারণ একটা জিনিস শিখবেন।
এর আরেকটা অদ্ভুত অর্থ ছিল—"দুটি ধনুকের অর্ধেক বাঁকানো অংশ।" এর মানে কী হতে পারে? এক ধনুকের অর্ধেক অংশ, আর অন্য ধনুকের অর্ধেক অংশ। قَابَ قَوْسَيْنِ (ক্ব-বা ক্বওসাইন) – দুটি ধনুক মিলে একটি সত্তা হয়ে যাচ্ছে।
শুনুন এবার… প্রাচীন আরবে একটা প্রথা ছিল। এই قَابَ قَوْسَيْنِ (ক্ব-বা ক্বওসাইন) অভিব্যক্তিটি তাদের সংস্কৃতির সাথে জড়িত।
যখন দুটি গোত্রের প্রধান একে অপরের সাথে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতো, তখন তারা নিজেদের গোত্র থেকে একটি করে ধনুক আনতো। তারপর তারা একটি ধনুকের ওপর আরেকটি ধনুক রাখতো, একদম স্তুপ করে। এরপর তারা দুটো ধনুকের হাতল একসাথে ধরতো, দুটো ছিলাকেও একসাথে ধরতো, তারপর দুটোকে একসাথে টেনে একটি তীর ছুড়তো। তীরটি কিন্তু একটি ধনুক থেকে নয়, বরং একই সাথে দুটি ধনুক থেকে বের হতো।
এটা এই কথার ইঙ্গিত দিত যে এখন থেকে একজনের সন্তুষ্টি অন্যজনেরও সন্তুষ্টি। আর একজনের ক্রোধ অন্যজনেরও ক্রোধ। এর মানে হলো, আমরা এখন এক হয়ে গেছি। যা তোমাকে খুশি করে, তা আমাকেও খুশি করে; যা তোমাকে কষ্ট দেয়, তা আমাকেও কষ্ট দেয়। আমরা এখন এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আমরা আক্ষরিক অর্থেই একসাথে বাঁধা পড়েছি। সেই দড়ির উপমা আবার ফিরে আসছে, তাই না? কী সুবহানাল্লাহ!
কুরআনের এই শৈল্পিক ভাষা উপলব্ধি করতে হলে আমাদেরকেও চিন্তাশীল হতে হবে। এই فَكَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর দূত জিবরীল (আঃ) এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ ﷺ-এর মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি করা হচ্ছে।
এরপর তিনি বলছেন, فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ (অতঃপর তিনি তাঁর দাসের প্রতি যা ওয়াহী করার তা ওয়াহী করলেন)। আল্লাহ বলতে পারতেন, "অতঃপর তিনি তাঁর প্রতি এই কুরআন ওয়াহী করলেন।" কিন্তু তিনি তা বলেননি। তিনি বলেছেন, "তিনি তাঁর দাসের কাছে তা-ই পৌঁছে দিলেন, যা পৌঁছানোর ছিল।" مَا أَوْحَىٰ (মা আওহা) – এখানে একটা অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে। কেন?
এই ইচ্ছাকৃত অস্পষ্টতাটা খুব সুন্দর। "যা কিছু তিনি ওয়াহী করেছেন"—এই কথাটা আমাদের মধ্যে একটা বিস্ময় জাগিয়ে তোলে। কী এমন ওয়াহী করা হয়েছিল? কী দেওয়া হয়েছিল? আমার আরও জানতে ইচ্ছে করে। আর সত্যি বলতে, আপনি যদি সারা জীবনও কুরআন শুনে থাকেন, আমরা কি আসলেই বুঝতে পেরেছি? আমরা যা শুনছি, তা কি এখনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট নয়? এই অস্পষ্টতা যেন বলছে, "তুমি তো কুরআনের কিছুই জানো না। এই বিশাল সমুদ্র থেকে তুমি মাত্র কয়েক ফোঁটা পেয়েছ।" আর সেটাই লুকিয়ে আছে مَا أَوْحَىٰ (মা আওহা)-এর ভেতরে।
আমি আমার সারা জীবন কুরআন অধ্যয়ন করে কাটিয়ে দিতে পারি, কিন্তু দিনশেষে আমি এর থেকে মাত্র কয়েক ফোঁটাই অর্জন করতে পারবো। মাত্র কয়েক ফোঁটা। আমি আর আমার এক সোহাইব মিলে এক বছর ধরে শুধু সূরা ইউসুফ অধ্যয়ন করেছিলাম। পুরো এক বছর। আর গত মাসে যখন আমরা সূরা ইউসুফ অনুবাদ করতে বসলাম, তখন আমাদের মনে হলো, আমরা তো এতদিন কিছুই বুঝিনি! এমন সব নতুন অর্থ আমাদের সামনে এলো, যা পুরো এক বছরেও আসেনি। আর আমি বাজি ধরে বলতে পারি, আমরা যদি আজ আবার সূরা ইউসুফ পড়া শুরু করি, তাহলে মনে হবে যেন একদম নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। এটাই হলো এই কুরআন। এর প্রজ্ঞার মধ্যে এক রহস্য লুকিয়ে আছে। এটা খুলতেই থাকে, উন্মোচিত হতেই থাকে।
এখানে আরও একটি সুন্দর অস্পষ্টতা আছে। فَأَوْحَىٰ (ফাআওহা) – "তিনি ওয়াহী করলেন।" এটা হতে পারে জিবরীল (আঃ) ওয়াহী করেছেন। কারণ আল্লাহ জিবরীলকে ওয়াহী করেছেন, আর জিবরীল (আঃ) নবীকে। কিন্তু আয়াতে বলা হয়েছে, إِلَىٰ عَبْدِهِ (ইলা 'আবদিহি) – "তাঁর দাসের প্রতি।" 'তাঁর দাস' বলতে পরিষ্কারভাবে কার দাস বোঝানো হচ্ছে? আল্লাহর দাস। এখানে এমনভাবে বলা হয়েছে যে আপনি এটাকে এভাবেও পড়তে পারেন: "আল্লাহ তাঁর দাসের প্রতি ওয়াহী করেছেন," অথবা "জিবরীল (আঃ) আল্লাহর দাসের প্রতি ওয়াহী করেছেন।" দুটোই একসাথে সম্ভব, কারণ আল্লাহ, জিবরীল এবং রাসূলের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।
এখন আমি আপনাদেরকে আরবিতে 'মিথ্যা' শব্দের গভীরে নিয়ে যাব। এই আয়াতটি বুঝতে হলে এটা জানা জরুরি।
আরবিতে মিথ্যা হলো كَذَبَ (কাযাবা)। আর যে মিথ্যা বলে, সে হলো كاذب (কাযিব)। সহজ অনুবাদ, তাই না? কিন্তু এখন আপনারা জানেন, আরবিতে কোনো কিছুই এত সহজ নয়। প্রত্যেক শব্দের একটা প্রাথমিক অর্থ থাকে, আর থাকে গৌণ অর্থ। আমি আপনাদের كَذَبَ (কাযাবা)-এর কিছু গৌণ অর্থ শেখাবো।
আরবরা বলে, كَذَبَ الْحَرُّ (কাযাবাল হার্রু) – যখন গরমের তীব্রতা কমে যায় এবং আবহাওয়া মনোরম হয়। মানে যখন তীব্রতা 'ভেঙে' যায়।
আবার, كَذَبَتِ الْعَيْنُ (কাযাবাতিল 'আইনু) – যখন চোখ মরীচিকা দেখে বিভ্রান্ত হয়। চোখ তখন যা দেখছে, তা আসলে সত্যি নয়।
আবার, كَذَبَ السَّيْرُ (কাযাবাস সাইরু) – যখন কোনো প্রাণী বা মানুষ টলমল করে হাঁটে, দৃঢ়ভাবে হাঁটতে পারে না। তখন বলা হয়, তার হাঁটার মধ্যে كَذَبَ (কাযাবা) আছে।
আবার, كَذَبَ الْوَحْشِيُّ (কাযাবাল ওয়াহশিয়্যু) – যখন কোনো বন্য প্রাণী কিছুক্ষণ দৌড়ে থেমে যায়, আর পেছনে ফিরে তাকায় কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না, তারপর আবার একটু দৌড়ায়, আবার দ্বিধা করে—এই ইতস্তত করাকেও كَذَبَ (কাযাবা) বলা হয়।
আবার, যখন একদল লোক আর ভ্রমণ করতে পারে না, কারণ তাদের টাকা ফুরিয়ে গেছে বা তারা ক্লান্ত—তখন বলা হয় তারা كَذَبَ (কাযাবা) করেছে, মানে তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে।
এর মানে দাঁড়ায়, كَذَبَ (কাযাবা) মানে কাপুরুষ হওয়া বা হাল ছেড়ে দেওয়াও হতে পারে।
এই সবগুলো অর্থের মধ্যে মূল ভাবটা কী? মূল ভাবটা হলো, "কোনো কিছুর তীব্রতা বা দৃঢ়তা কমে যাওয়া।" যখন কোনো কিছু দুর্বল হয়ে যায়, ভেঙে পড়ে, নরম হয়ে যায়, তখন তাকে كَذَبَ (কাযাবা) বলা হয়। এর অর্থ হতে পারে তীব্রতা হ্রাস, দৃঢ়তা হারানো, দুর্বলতা, কাপুরুষতা, ভুল ধারণা এবং সুবিধাবাদ।
এর সাথে মিথ্যার কী সম্পর্ক? ইসলাম আসারও আগে আরবরা বুঝত যে, 'সত্য' এই সবকিছুর বিপরীত। সত্য তীব্র হয়। সত্যের জন্য যোগ্যতা লাগে। সত্যের জন্য দৃঢ়তা ও মনোবল লাগে। সত্যের জন্য সাহস লাগে। সত্যকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হয়। আর সত্য প্রায়ই অসুবিধাজনক হয়।
আর যখন আপনি সুবিধার পেছনে ছোটেন, যখন আপনি কাপুরুষতার কাছে নতি স্বীকার করেন, তখনই মিথ্যা বলা সহজ হয়ে যায়। যারা সহজ পথ খোঁজে, তারাই মিথ্যুক হয়। এটাই হলো كَذَبَ (কাযাবা)।
তো, যখন আল্লাহ বলেন, مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ (অন্তর যা দেখেছে, তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি), তখন আপনি যখন আরবিতে 'মিথ্যা' শব্দটি শুনবেন, তখন এর পেছনের এই গভীর অর্থগুলো আপনার মনে ভেসে উঠবে। এটা কি অসাধারণ নয়? শব্দের এই গভীরতা জানা থাকলে সবকিছু বদলে যায়।
এখানে যারা ভাইয়েরা আছেন, ভাবুন তো, আপনার স্ত্রী আপনাকে জিজ্ঞেস করলো, "কী ভাবছো?" আপনাদের মধ্যে একজনও কি তাকে সত্যিটা বলবে? আপনার মাথায় হয়তো চলছে, "কাজটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি," বা অন্য কোনো গভীর বিষয়। কিন্তু আপনি কি বলবেন? না। কারণ সত্যিটা বললে জীবনটা খুব 'অসুবিধাজনক' হয়ে যেতে পারে। তাই চুপ করে থাকাই ভালো। এটাই হলো كَذَبَ (কাযাবা)।
তো, مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ (মা কাযাবাল ফু'আদ) – এই আয়াতের গভীরে যাওয়ার আগে এই শব্দটির অর্থ বোঝাটা জরুরি ছিল।