চলুন,
আজ আমরা
সূরা আন-নাজমের
দ্বিতীয় আয়াতটি নিয়ে কথা
বলি।
আল্লাহ
বলছেন:
مَا
ضَلَّ
صَاحِبُكُمْ
وَمَا
غَوَىٰ
তোমাদের
সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং
বিভ্রান্তও
হননি।
এই
একটি আয়াতের
ভেতরেই তিনটি শব্দ
আছে, যা
অসাধারণ।
প্রথমটি
হলো ضَلَّ
(দল্লা) যার অর্থ
পথভ্রষ্ট
হওয়া।
দ্বিতীয়টি
হলো صَاحِب
(সাহিব) অর্থাৎ সঙ্গী।
আর
তৃতীয়টি غَوَىٰ
(গাওয়া) যার অর্থ
বিভ্রান্ত
হওয়া।
আজ
আমরা এই
শব্দগুলোর
গভীরে ডুব দেবো।
বিশ্বাস করুন, এটা
আপনার কুরআন
বোঝার যাত্রায় দারুণভাবে
সাহায্য করবে, কারণ
এই শব্দগুলো
কুরআনে বারবার ফিরে আসে।
দেখুন,
আরবি ভাষা
কিন্তু অন্য দশটা
ভাষার মতো নয়।
এখানে প্রত্যেকটি
শব্দের একটি মূল
বা প্রধান
অর্থ থাকে,
আবার তার
সাথে জড়িয়ে
থাকে আরও
কিছু গৌণ
অর্থ। ব্যাপারটা
অনেকটা এরকম ধরুন,
আপনি একটা
বার্গার খাচ্ছেন। মূল জিনিসটা
হলো প্যাটি
আর বান।
কিন্তু আসল স্বাদটা
কখন আসে?
যখন এর
সাথে মেশে
কেচাপ, মেয়োনিজ, মাস্টার্ড
সস। ঠিক
তেমনই, আরবি শব্দের
মূল অর্থের
সাথে যখন
এই গৌণ
অর্থগুলো
মেশে, তখনই
এর পুরো
গভীরতা আর সৌন্দর্যটা
ফুটে ওঠে।
তো,
ضَلَّ
(দল্লা) শব্দটির কথাই ধরুন।
এর প্রধান
অর্থ আমরা
সবাই জানি পথভ্রষ্ট হওয়া, বা
হারিয়ে যাওয়া।
কিন্তু
এখানেই শেষ নয়।
আসুন এর
ভেতরের স্তরগুলো দেখি।
আরবরা
এই শব্দটি
কখন ব্যবহার
করত?
১. যখন কোনো কিছু
চোখের আড়ালে চলে
যেত, পুরোপুরি
লুকিয়ে যেত, তারা
বলত ضَلَّ।
অর্থাৎ, যা অদৃশ্য
হয়ে গেছে।
২. মনে করুন, আপনি
এক গ্লাস
দুধের মধ্যে কয়েক
ফোঁটা পানি মেশালেন।
মেশানোর পর কি আর পানিটাকে
আলাদা করে চেনা
যায়? যায়
না। এই
যে এমনভাবে
মিশে যাওয়া
যে আলাদা
করার উপায়
থাকে না,
একেও আরবরা
বলত ضَلَّ।
৩. আবার ধরুন, কাউকে
কবর দেওয়ার
পর এমনভাবে
মাটি চাপা
দেওয়া হলো যে,
বোঝাই যাচ্ছে না কবরটা
ঠিক কোথায়।
এই পুরোপুরি
ঢাকা পড়ে
যাওয়াকেও
বলা হতো
ضَلَّ।
৪. এমনকি
পাথরের নিচে লুকিয়ে
থাকা পানি,
যা চোখে
দেখা যায়
না, তাকেও
ضَلَلْ
বলা হতো।
কিংবা পাহাড়ি উপত্যকায় লুকিয়ে থাকা পাথর,
যা সহজে
নজরে আসে
না, তাকে
বলা হতো
ضَلَادِلْ।
মূল কথা
হলো লুকিয়ে
থাকা, আবৃত
থাকা।
৫. আরেকটা
অসাধারণ উদাহরণ দেই। ধরুন,
আপনি আমার
বাড়িতে আসবেন বলে
বেরিয়েছেন,
কিন্তু গুগল ম্যাপস
আপনাকে ভুল রাস্তা
দেখিয়ে অন্য কোথাও,
ধরুন একটা
ম্যাকডোনাল্ডসের
সামনে নামিয়ে দিল। আপনি
নিজের ভুলে ভুল
গন্তব্যে
পৌঁছালেন।
এই অবস্থাকেও
আরবরা বলত ضَلَلْتُ
الدَّارَ।
৬. আবার কোনো কিছু
নষ্ট বা
ধ্বংস হয়ে গেলেও
এই শব্দ
ব্যবহার হতো। যেমন
কুরআনে এসেছে: أَلَمْ
يَجْعَلْ
كَيْدَهُمْ
فِي
تَضْلِيلٍ
আল্লাহ কি তাদের
ষড়যন্ত্রকে
নষ্ট করে
দেননি? অর্থাৎ, তাদের সব
পরিকল্পনা
ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন।
৭. সবশেষে,
এমন একজন
মানুষ যাকে খুব
সহজেই বোকা বানানো
যায়, ধোঁকা
দেওয়া যায়, বা
যে অন্যের
কথায় সহজে
প্রভাবিত
হয়ে যায়,
তাকে বলা
হতো رَجُلٌ
ضَالٌّ।
তাহলে
দেখুন, ضَلَّ
মানে শুধু
হারিয়ে যাওয়া নয়।
এর মানে
হলো:
চোখের আড়ালে চলে
যাওয়া।
এমনভাবে মিশে যাওয়া
যে চেনা
যায় না।
পুরোপুরি
ঢাকা পড়ে
যাওয়া।
নিজের ভুলে ভুল
পথে চলে
যাওয়া।
নষ্ট বা
ধ্বংস হয়ে যাওয়া।
আর এমন
কেউ, যে
সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
এবার
আয়াতটিতে
ফিরে আসি।
আল্লাহ যখন বলেন,
مَا
ضَلَّ
صَاحِبُكُمْ
তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট
হননি তখন
তিনি আসলে
কী বলছেন?
তিনি
বলছেন, তিনি পথ
হারাননি, বরং তিনিই
আল্লাহর পক্ষ থেকে
সঠিক পথ
পেয়েছেন।
তিনি বিভ্রান্ত
নন। তিনি
অন্যের কথায় প্রভাবিত
হননি। তাঁর চিন্তা
বা প্রচেষ্টা
ব্যর্থ বা নষ্ট
হয়ে যায়নি।
আর
মনে করুন
সেই দুধ
আর পানির
উদাহরণটা।
যখন দুটো
জিনিস মিশে গিয়ে
এক হয়ে
যায়… আল্লাহ
এখানে বলছেন, তোমাদের
নবী ﷺ
সত্য আর
মিথ্যাকে
গুলিয়ে ফেলছেন না। তিনি
নিজের কথা আর
আল্লাহর বাণীকে একसाथ
মিশিয়ে দিচ্ছেন না। কারণ
ضَلَّ-এর
একটা অর্থই
হলো মিশে
যাওয়া। আল্লাহ স্পষ্ট করে দিচ্ছেন এটা তাঁর
নিজের কথা নয়,
এটা আল্লাহর
কথা। তিনি
দুটোকে মেশাননি।
মক্কার
লোকেরা বলত, মুহাম্মাদ,
তুমি তো
আমাদের মধ্যে সবচেয়ে
বুদ্ধিমান,
সবচেয়ে সম্মানিত, সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী ছিলে! আর
এখন এই
নবুয়তের দাবি করছো?
কী দুর্ভাগ্য!
তোমার জীবনটা নষ্ট হয়ে
গেল! আমরা
তোমাকে হারিয়ে ফেললাম!
ঠিক
যেমন আরেকজন
নবীকে তাঁর قوم
বলেছিল: كُنتَ
فِينَا
مَرْجُوًّا
আমরা তো
তোমার ব্যাপারে কত আশা
করতাম!
কিন্তু
আল্লাহ বলছেন, না।
তিনি হারাননি।
তোমরাই হারিয়ে গেছ। তোমরাই
ধ্বংসের পথে তিনি
নন।
এবার
আসুন পরের
শব্দটিতে।
আমি صَاحِب
(সাহিব) শব্দটিতে পরে ফিরব,
তার আগে
غَوَىٰ
(গাওয়া) শব্দটি বোঝা খুব
জরুরি।
غَوَىٰ
(গাওয়া) শব্দটিরও কয়েকটি অসাধারণ অর্থ আছে।
১. আরবরা
মরুভূমিতে
ঝাঁকে ঝাঁকে আসা
পঙ্গপালকে
বলত غَوِى।
কারণ পঙ্গপালের
ঝাঁক সবকিছুকে
আচ্ছন্ন করে ফেলে,
ঢেকে দেয়।
২. দুধ খাওয়ার পর পেটে
যখন তীব্র
গ্যাস বা অস্বস্তি
হতো, যা
শরীরকে চেপে ধরত,
সেই অবস্থাকে
বলা হতো
الغَوَى।
৩. এমন কিছু যা
অন্ধকার দিয়ে ঢেকে
ফেলে, যেমন
ছায়া, তাকে
বলা হতো
أَغْوَى।
৪. আবার,
অতর্কিতে
হামলা করার জন্য
ওত পেতে
থাকাকে বলা হতো
تَغَوَّى।
৫. কাউকে
ইচ্ছাকৃতভাবে
ভুল পথে
চালিত করাকে বলা
হতো أَرْضٌ
مِغْوَاة।
৬. এমনকি
ফাঁদকেও বলা হতো
أُغْوِيَّة।
যেমন, নেকড়ে
ধরার জন্য
গর্তে ছাগল ফেলে
রেখে ফাঁদ
পাতা হতো।
এর মানে
হলো পরিকল্পিতভাবে
কাউকে ধ্বংস করা।
৭. আর সবশেষে, বিকৃত চিন্তাভাবনা
এবং মিথ্যার
প্রতি আসক্তিকেও
غَوَىٰ
বলা হয়।
তাহলে
দেখুন, غَوَىٰ
মানে কী?
এর মানে
হলো ইচ্ছাকৃতভাবে
ঢেকে ফেলা,
কাউকে চেপে ধরা,
পরিকল্পিতভাবে
ফাঁদ পাতা,
বিভ্রান্তি
ছড়ানো, মানসিকভাবে
কাউকে আচ্ছন্ন করা, এবং
জেনে-বুঝে
ভুল বিশ্বাসে
ডুবে থাকা।
এবার
পুরো আয়াতটি
একসাথে দেখুন:
مَا
ضَلَّ
صَاحِبُكُمْ
وَمَا
غَوَىٰ
তোমাদের
সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং
বিভ্রান্তও
হননি।
এখানে
মক্কার কাফিরদের দুটি অভিযোগকেই
আল্লাহ ভেঙে দিচ্ছেন।
তাদের
একদল বলত:
তিনি ضَلَّ অর্থাৎ, তিনি পথ
হারিয়ে ফেলেছেন, তিনি দিশেহারা,
তিনি কী
বলছেন নিজেই জানেন
না। এটা
ছিল অনিচ্ছাকৃত
ভুলের অভিযোগ।
আরেকদল
আরও চতুর
ছিল। তারা
বলত: তিনি
غَوَىٰ অর্থাৎ, তিনি একজন
চতুর প্রতারক।
তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে
আমাদের ধোঁকা দিচ্ছেন,
নিজের স্বার্থে একটা ফাঁদ
পেতেছেন।
আল্লাহ
এক আয়াতে
দুটি অভিযোগই
খণ্ডন করে দিলেন।
তিনি বলছেন না, তিনি
কোনো দিশেহারা
নন (مَا
ضَلَّ),
আবার তিনি
কোনো চতুর
প্রতারকও
নন (وَمَا
غَوَىٰ)।
অথচ
মজার ব্যাপার
হলো, মক্কার
কাফিরদের
মধ্যেই এই দুই
ধরনের লোক ছিল।
কেউ ছিল
ضَلَّ সত্যিই পথভ্রষ্ট ও
বিভ্রান্ত।
আর কেউ
ছিল غَوَىٰ যারা জেনে-বুঝে
মানুষকে ভুল পথে
টানত, সত্যের
বিরুদ্ধে
ফাঁদ পাতত।
আল্লাহ যেন বলছেন,
নবী ﷺ
নন, বরং
তোমরাই সেই দুই
দলের অন্তর্ভুক্ত।
এবার
আসুন সেই
আশ্চর্য শব্দটির দিকে: صَاحِبُكُمْ
তোমাদের সঙ্গী ।
আরবিতে
সাহিব শব্দটি এসেছে صَحِبَ
থেকে, যার
মানে সঙ্গে
থাকা । এই শব্দটিকে
বোঝানোর জন্য আরবরা
এক অসাধারণ
চিত্রকল্প
ব্যবহার করত শৈবাল
(moss)। শৈবাল যেমন একটা
দেয়ালের গায়ে, একটা
পাথরের গায়ে লেপ্টে
থাকে, ঠিক
তেমনই সাহিব হলো
সেই ব্যক্তি,
যে তোমার
জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে
জড়িয়ে আছে। সে
হয়তো তোমার
মতো নয়,
কিন্তু সে তোমার
জীবনেরই একটা অংশ।
অনেকটা তোমার ত্বকের
লোমের মতো যা
আলাদা, কিন্তু তোমার শরীরেরই
অঙ্গ।
সাহিব
হলো সেই
ব্যক্তি, যে তোমার
সাথে এত
ঘনিষ্ঠভাবে
থেকেছে যে সে তোমার ভেতর-বাহির
সব জানে।
তোমার আনন্দ, তোমার
ভয়, তোমার
শক্তি, তোমার দুর্বলতা সবকিছু তার জানা।
একটা
বাস্তব উদাহরণ দেই। আজকের
দিনের সেলিব্রেটিদের
কথা ভাবুন।
আমরা তাদের
পর্দায় একরকম দেখি,
কিন্তু বাস্তবে তারা কি
আসলেই সেরকম? তাদের
ভক্তরা তাদের জন্য
পাগল, বলে,
"I love you! You are the best!" কিন্তু
বাস্তবে তাদের সবচেয়ে
বেশি ঘৃণা
করে কারা,
জানেন? অনেক ক্ষেত্রে,
তাদের প্রতিবেশী,
তাদের ড্রাইভার, তাদের জীবনসঙ্গী,
সন্তান, ভাইবোন অর্থাৎ, যারা তাদের
সত্যিকারের
সাহিব , যারা তাদের
কাছ থেকে
চেনে।
আল্লাহ
এখানে বলছেন, صَاحِبُكُمْ
তোমাদের সেই সঙ্গী,
যাকে তোমরা
অন্তর-বাহির
থেকে চেনো।
আল্লাহ
যেন তাদের
বিবেককে নাড়া দিয়ে
বলছেন:
এই মানুষটার
সাথে তোমরা
জন্মেছো, বড় হয়েছো।
তার সাথে
ব্যবসা করেছো, ওঠাবসা
করেছো, জীবন কাটিয়েছো।
তোমরা কি সত্যিই
বলতে পারো
যে সে
পথভ্রষ্ট?
সে একজন
প্রতারক?
তোমরা
তো ভালো
করেই জানো
সে ছিল
তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে
বিশ্বাসযোগ্য।
সবচেয়ে বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান।
যার ওপর
তোমরা সবসময় চোখ
বন্ধ করে
ভরসা করতে।
আর
আজ সেই
মানুষটার
ব্যাপারে
তোমরা বলছো, قَدْ
غَوَىٰ
"সে বিভ্রান্ত
হয়ে গেছে!"
তোমরা
কি মজা
করছো?
আল্লাহ
তাই এক
অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলছেন:
مَا
ضَلَّ
صَاحِبُكُمْ
وَمَا
غَوَىٰ
তোমাদের
সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং
বিভ্রান্তও
হননি।
একবার
ভাবুন, এটা কতটা
শক্তিশালী
একটি বাক্য!
এটা
শুধু কুরাইশদের
নোংরা অভিযোগকেই
চূর্ণবিচূর্ণ
করে না,
বরং এই
অভিযোগের
মধ্য দিয়েই
আল্লাহ এক অনন্য
সৌন্দর্য
ফুটিয়ে তোলেন। তিনি বলছেন এমনকি যদি
কেউ ওহির
ওপর বিশ্বাস
না-ও করে,
যদি কেউ
কুরআনের কথা না-ও
মানে, तरीও
তাদের সাহিব তাদের
এত কাছের
মানুষটির
চরিত্র আর জীবনই
তো তার
সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
তাঁর
জীবনের সাক্ষী তো তোমরাই!
সুবহানাল্লাহ!
مَا
ضَلَّ
صَاحِبُكُمْ
وَمَا
غَوَىٰ
তোমাদের
সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং
বিভ্রান্তও
হননি।