চলুন,
আজ আমরা
আরবি ভাষার
এক অসাধারণ
মূলধাতু নিয়ে কথা
বলি, আর
সেটি হলো
ر–ح–م (র-হা–মীম)।
এই তিনটি
অক্ষর থেকে এমন
সব শব্দ
এসেছে, যা আমাদের
জীবনের প্রতিটি স্তরের সাথে জড়িয়ে
আছে।
এর
সবচেয়ে মৌলিক অর্থটি
শুরু হয়
رَحْمٌ
(রহম) বা
رِحْمٌ
(রিহম) দিয়ে,
যার মানে
হলো মায়ের
গর্ভ। একবার ভাবুন
তো, মায়ের
গর্ভ কী?
এক এমন
নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে
একটি শিশু
পৃথিবীর সমস্ত আঘাত
থেকে সুরক্ষিত
থাকে, যেখানে
সে বেড়ে
ওঠে, পুষ্টি
পায়।
আর
এই মূল
ধারণা থেকেই এসেছে
رَحْمَۃٌ
(রাহমাহ) শব্দটি। ঠিক যেমন
মায়ের গর্ভ একটি
শিশুকে আগলে রাখে,
তেমনই আল্লাহর ‘রাহমাহ‘ আমাদের জীবনের সমস্ত অপূর্ণতাকে
পূর্ণ করে দেয়।
এটা এমন
এক উপহার,
যা কোনো
কিছুর বিনিময়ে আসে না।
এটা আল্লাহর
পক্ষ থেকে
এক নিখাদ
করুণা, এক এমন
দান, যা
আমাদের প্রয়োজন অনুসারে আমাদের কাছে পৌঁছে
যায়। এক
কথায়, ‘রাহমাহ‘
হলো সেই
সব নিয়ামত,
যা আমরা
আল্লাহর কাছ থেকে
কোনো মূল্য
পরিশোধ না করেই
পাই।
সূরা
আর-রূমে আল্লাহ মানুষের এক অদ্ভুত
আচরণের কথা বলছেন:
وَاِذَا
اَذَقْنَاالنَّاسَ
رَحْمَةً
فَرِحُوْابِهَ
وَ
اِنْ
تُصِبْهُمْ
سَیِّئَةٌ
بِمَا
قَدَّمَتْ
اَیْدِیْهِمْ
اِذَا
هُمْ
یَقْنَطُوْنَ
আর
যখন আমি
মানুষকে আমার করুণা
(রাহমাহ) আস্বাদন করাই, তখন
তারা এতে
উল্লসিত হয়, কিন্তু
যখন তাদের
নিজেদের কৃতকর্মের
ফলে তাদের
উপর কোনো
বিপদ (সাইয়্যিয়াহ)
আসে, তখন
তারা হতাশ
হয়ে পড়ে।
(সূরা আর-রূম,
৩০:৩৬)
দেখুন,
এখানে আল্লাহ رَحْمَۃٌ
(রাহমাহ)-এর বিপরীতে
سَیِّئَةٌ
(সাইয়্যিয়াহ)
বা বিপদ
শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর মানে
কী? এখানে
‘রাহমাহ‘ বলতে জীবনের
সেই সব
ভালো জিনিস,
সেই সব
আনন্দ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে
বোঝানো হচ্ছে, যা
আমরা আল্লাহর
কাছ থেকে
কোনো বিনিময়
ছাড়াই পাই।
আবার
দেখুন, সূরা বনি
ইসরাঈলে সন্তানের আকুতি কতটা
সুন্দরভাবে
ফুটে উঠেছে,
যখন সে
তার বাবা-মায়ের
জন্য দোয়া
করে:
وَقُلْ
رَّبِّ
ارْحَمْهُمَا
کَمَا
رَبَّیٰنِیْ
صَغِیْراً
এবং
বলো, হে
আমার রব,
তাদের দুজনের প্রতি রহম
করুন, যেমন
তারা শৈশবে
আমাকে লালন-পালন করেছিলেন ।
(সূরা বনি
ইসরাঈল,
১৭:২৪)
এখানে
রহম কী?
সন্তানের
জন্য বাবা-মায়ের
সেই নিঃস্বার্থ
ভালোবাসা,
সেই যত্ন,
সেই প্রতিপালন এটাই ছিল
সন্তানের
জন্য ‘রাহমাহ‘।
এই
‘রাহমাহ‘ শব্দটি আরও অনেক
অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন:
বৃষ্টি, যা মাটি
থেকে আমাদের
জন্য রিজিক
তৈরি করে সেটাও আল্লাহর
‘রাহমাহ‘ (দেখুন সূরা
রূম ৩০:৪৬, শূরা ৪২:২৮)।
জীবনের সেই সব
নিয়ামত (نَعْمَاءُ
– না’মা), যা
আমরা কোনো
মূল্য ছাড়াই পাই,
সেটাও ‘রাহমাহ‘ (দেখুন সূরা
হূদ
১১:৯-১০)।
মূসা
(আঃ)-এর
সেই ঘটনাটা
মনে আছে?
যেখানে এক প্রাচীরের
নিচে দুই
এতিম শিশুর
গুপ্তধন লুকানো ছিল। আল্লাহ
চেয়েছিলেন,
তারা বড়
হওয়ার পর যেন
সেই ধন
খুঁজে পায়। এই
যে আল্লাহর
পক্ষ থেকে
এক বিশেষ
ব্যবস্থা,
এক সুরক্ষা,
একেই কুরআন
বলছে رَحْمَۃٌ
(রাহমাহ) (দেখুন সূরা
কাহফ ১৮:৮২)।
‘রাহমাহ‘-এর আরেকটি
অর্থ হলো
কোনো কিছুকে
ঢেকে দেওয়া
বা সুরক্ষা
দেওয়া। এজন্যই কুরআন এই
শব্দটিকে
ضَرَرٌ
বা ক্ষতি –এর বিপরীতে
ব্যবহার করেছে (দেখুন
সূরা ইউনুস
১০:২১, রূম
৩০:৩৩)।
কিন্তু
আল্লাহর রিজিক তো
শুধু আমাদের
শরীরের জন্য নয়,
তাই না?
আমাদের ব্যক্তিত্ব,
আমাদের আত্মার বিকাশের জন্যও তো
রিজিক দরকার। আর সেই
রিজিক কী? আল্লাহর
পক্ষ থেকে
পাঠানো জীবন ব্যবস্থা
অর্থাৎ ‘ওয়াহী‘ বা
ঐশী জ্ঞান।
এজন্যই কুরআন এই
ওয়াহীকেও
رَحْمَۃٌ
(রাহমাহ) বলেছে (দেখুন
সূরা যুখরুফ
৪৩:৩২, বাকারা
২:১০৫)। কারণ সত্য
জ্ঞানই মানুষের বিকাশের সবচেয়ে বড় উৎস,
আর তা
পুরোটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে
আসে। তাই
এটি এক
বিশেষ ‘রাহমাহ‘।
আর
যেহেতু আল্লাহ হলেন رَبُّ
الْعَالَمِیْنَ
(রব্বুল আলামীন) অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বজগতের
প্রতিপালক তাই তিনি
নিজের উপর এই
দায়িত্ব নিয়েছেন যে, তিনি
এই ওয়াহী
বা জীবনবিধান
আমাদের কাছে পৌঁছে
দেবেন। যেমন তিনি
বলেন:
کَتَبَ
رَبُّکُمْ
عَلٰی
نَفْسِهِ
الرَّحْمَةَ
তোমাদের
রব নিজের
উপর রাহমাহ কে
(করুণা) বাধ্যতামূলক
করে নিয়েছেন।
(সূরা আন আম, ৬:৫৪)
তিনি
তাঁর এই
করুণার চাদর দিয়ে
পুরো সৃষ্টিজগতকে
ঢেকে রেখেছেন।
আর একারণেই
সূরা ফাতিহায়
رَبُّ
الْعَالَمِیْنَ
(রব্বুল আলামীন)-এর পরেই
বলা হয়েছে
اَلرَّحْمٰنِ
الرَّحِیْمِ
(আর-রাহমানির
রাহীম)।
এখন
প্রশ্ন হলো, اَلرَّحْمٰنُ
(আর-রাহমান)
এবং اَلرَّحِیْمُ
(আর-রাহীম)-এর মধ্যে
পার্থক্য
কী?
ভাষাগতভাবে, رَحِیْمٌ
(রাহীম) হলেন তিনি,
যিনি তাঁর
করুণা বা রিজিক
অবিরাম ও ধারাবাহিকভাবে
দিয়ে চলেন।
আর رَحْمٰنُ
(রাহমান) হলেন তিনি,
যাঁর করুণা
অপ্রতিরোধ্যভাবে
বর্ষিত হয়, বিশেষ
করে যখন
প্রয়োজনটা
হয় তীব্র।
সহজ
করে বললে,
‘রাহীম‘ হলো একটি
চলমান, দীর্ঘমেয়াদী
করুণা। আর ‘রাহমান‘
হলো আকস্মিক,
তীব্র ও বিশাল করুণার
প্রকাশ।
সূরা
আর-রাহমানে
আল্লাহ বলছেন:
یَسْءَلُهٌ
مَنْ
فِی
السَّمٰوٰتِ
وَالْاَرضِ
کُلَّ
یَوْمٍ
هُوَ
فِیْ
شَانٍ
আসমান
ও জমিনে যা কিছু
আছে, সবাই
তাঁর কাছেই
সাহায্য চায়। তিনি
প্রত্যেক
দিনই নতুন
নতুন মহিমায়
ব্যস্ত। (সূরা আর-রাহমান,
৫৫:২৯)
এর
মানে কী?
সৃষ্টিজগতের
কোনো কিছুই
এক অবস্থায়
থাকে না।
সময়ের সাথে সাথে
সবকিছু বদলায়। ভাবুন তো,
মায়ের গর্ভে থাকা
একটি শিশুর
যা প্রয়োজন,
একজন প্রাপ্তবয়স্ক
মানুষের প্রয়োজন কি তার
থেকে একদম
আলাদা নয়? আল্লাহ
প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি অবস্থায়, তার প্রয়োজন
অনুযায়ী করুণা ও রিজিক দিয়ে
চলেছেন। এই যে শুরু থেকে
শেষ পর্যন্ত
প্রতিটি ধাপে নিখুঁতভাবে
পালন করা,
এটাই ‘রব‘,
‘রাহমান‘ এবং ‘রাহীম‘-এর সম্মিলিত
অর্থ।
এবার
আসুন মূল
শব্দটিতে
ফিরে যাই।
رِحْمٌ
(রিহম) বা
মায়ের গর্ভ থেকে
আরেকটি অর্থ এসেছে আত্মীয়তার
সম্পর্ক, রক্ত সম্পর্ক।
যেমন আরবরা
বলত, بَیْنَهُمَا
رِحْمٌ
(বাইনাহুমা
রিহম), অর্থাৎ
"তাদের দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ
আত্মীয়তা
রয়েছে"। কুরআনেও اَرْحَامٌ
(আরহাম), যা رِحْمٌ
(রিহম)-এর
বহুবচন, আত্মীয়-স্বজন
অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে (যেমন:
اُولُوا
الأَرْحَامِ
– উলুল আরহাম,
অর্থ: রক্ত-সম্পর্কীয়
আত্মীয়)।
আর
যেহেতু মায়ের গর্ভ
বা ‘রিহম‘-এর সাথে
কোমলতা ও নরম অনুভূতির
একটি যোগসূত্র
আছে, তাই
এই মূল
থেকে আরেকটি
অর্থ এসেছে নরম হওয়া,
দয়ার্দ্র
হওয়া। যেমন আল্লাহ
সাহাবীদের
ব্যাপারে
বলেন:
اَشِدَّاءُ
عَلَی
الْکُفَّارِ
رُحَمَاءُ
بَیْنَهُمْ
তাঁরা
কাফিরদের
প্রতি অত্যন্ত কঠোর, কিন্তু
নিজেদের মধ্যে পরস্পরের
প্রতি অত্যন্ত কোমল ও দয়ার্দ্র
(রুহামা)।
(সূরা ফাতহ,
৪৮:২৯)
দেখুন, رُحَمَاءُ
(রুহামা) শব্দটি সেই একই
মূল থেকে
এসেছে।
এখানে
একটা গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় পরিষ্কার
করা দরকার।
খ্রিষ্টীয়
বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশু তার
বাবা-মায়ের
পাপের বোঝা নিয়ে
জন্মায়, আর এই পাপ থেকে
মুক্তি কেবল ঈশ্বরের
করুণার মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু কুরআনের শিক্ষা এর থেকে
সম্পূর্ণ
ভিন্ন। কুরআন বলছে,
সাফল্য হলো কর্মের
স্বাভাবিক
ফল, আর
সবকিছুই আল্লাহর নির্ধারিত
আইন অনুযায়ী
ঘটে।
সেই মৌলিক
আইনটি কী?
لَیْسَ
لِاِنْسَانِ
اِلَّامَاسَعٰی
মানুষ
ততটুকুই পায়, যতটুকু
সে চেষ্টা
করে। (সূরা
নাজম,
৫৩:৩৯)
এর
মানে হলো,
ভালো কাজের
ভালো ফল
এবং মন্দ
কাজের মন্দ ফল।
হ্যাঁ, এটা ঠিক
যে কাজ
করার জন্য
প্রয়োজনীয়
ক্ষমতা, বুদ্ধি এবং আল্লাহর
পক্ষ থেকে
সঠিক পথের
নির্দেশনা এই সবকিছুই
আমরা বিনামূল্যে
পাই। আর
এই সবই
আল্লাহর ‘রাহমাহ‘-এর অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ আমাদের বিকাশের জন্য এই
মূলধনটা বিনামূল্যে
দিয়ে দেন।
এখন, যে ব্যক্তি এই মূলধনকে
কাজে লাগিয়ে
আল্লাহর আইন অনুযায়ী
নিজের ব্যক্তিত্বকে
গড়ে তুলবে,
সে-ই জীবনের
সাফল্য ও পুরস্কার লাভ করবে।
আর যে
তা করবে
না, সে
বঞ্চিত হবে। এটাই
আল্লাহর নিয়ম। সুতরাং,
মানুষ তার চূড়ান্ত
লক্ষ্যে পৌঁছায় কেবল আল্লাহর
করুণার ওপর ভিত্তি
করে নয়,
বরং আল্লাহর
দেওয়া করুণাকে কাজে লাগিয়ে
নিজের কর্মের ফলের মাধ্যমেই।
শেষে এসে, আরবি ভাষার
এই সৌন্দর্যের
দিকে আরেকবার
তাকাই। اَلرَّحْمٰنٌ (আর-রাহমান)
শব্দটি فَعْلَانٌ (ফা’লান)
ওজনের, যা কোনো
গুণের তীব্রতা ও আকস্মিকতাকে
বোঝায়। আর اَلرَّحِیْمٌ (আর-রাহীম)
শব্দটি فَعِیْلٌ (ফা’ঈল) ওজনের, যা
কোনো গুণের
স্থায়িত্ব
ও ধারাবাহিকতাকে
বোঝায়।
একই মূল থেকে কত
গভীর ও বহুমুখী অর্থ! সুবহানাল্লাহ