
চলুন,
আজকে আমরা
এমন একটি
শব্দ নিয়ে
কথা বলি,
যা আমাদের
জীবনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। শব্দটি হলো ‘আল্লাহ্’।
কিন্তু এই শব্দটির
শেকড় কোথায়?
এর গভীরতা
কতটুকু? আসুন, আমরা
এর মূল
অক্ষরগুলো
থেকে যাত্রা
শুরু করি:
أ–ل–ه (আলিফ-লাম-হা)।
বিখ্যাত
ভাষাবিদ ইবনে ফারিস
বলেছেন, এই অক্ষরগুলোর
মৌলিক অর্থ হলো
‘কারো অধীনতা
বা দাসত্ব
মেনে নেওয়া‘।
ব্যাপারটা
কতটা গভীর,
একটু ভাবুন
তো!
এবার
দেখুন এই মূল
থেকে কীভাবে
বিভিন্ন শব্দ বেরিয়ে
আসছে আর
তাদের অর্থগুলো কীভাবে একে অপরের
সাথে জুড়ে
আছে।
যেমন,
একটি শব্দ
হলো أَلِهَ (আলিহা),
বা إِلَيْهِ (ইলাইহি),
বা يَاْلُهُ (ইয়া’লুহু)।
এর অর্থ
হলো বিপদের সময়, চরম দুর্দশার
মুহূর্তে
কারো কাছে
আশ্রয় খোঁজা। যখন আপনি
একেবারে নিরুপায়, যখন চারদিকে
অন্ধকার, তখন আপনি
যার দিকে
ছোটেন, যার কাছে
সুরক্ষা চান সেই
ছুটে যাওয়াটাই
হলো ‘আলিহা‘।
আবার
দেখুন, آلِيْهَ (আলিইহা) এই শব্দটির
আরেকটি অর্থ হলো
‘অবাক বা
বিস্মিত হয়ে যাওয়া‘।
কোনো কিছু
এতটাই বিশাল, এতটাই
মহিমান্বিত
যে আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি
তাকে ধারণ
করতে পারে
না, আপনি
শুধু অবাক
হয়ে তাকিয়ে
থাকেন।
এর
ঠিক উল্টো
দিকে আছে
آلَهَ
(আ’লাহা) বা يَاْلُهَ
(ইয়া’লুহু)। এর মানে হলো
‘বিপদে পড়া কাউকে
আশ্রয় দেওয়া‘, বা
কাউকে নিজের সুরক্ষার
ছায়াতলে নিয়ে আসা।
তাহলে একদিকে যেমন কেউ
আশ্রয় খুঁজছে, অন্যদিকে কেউ একজন
আছেন যিনি
আশ্রয় দিচ্ছেন। এই কারণেই
আরবরা বলতেন, اَلِهَ بِالْمَكَانِ (আলিহা বিল-মাকান),
অর্থাৎ, সে ওই বাড়িতে শান্তিতে বসবাস করতে
লাগল, কারণ
বাড়িটি তাকে আশ্রয়
দিয়েছে।
তাহলে
এই সব
অর্থকে যদি আমরা
এক করি,
তাহলে إِلَهٌ
(ইলাহুন) শব্দটির মানে কী
দাঁড়ায়?
ইলাহ্ হলেন এমন একজন,
বিপদের মুহূর্তে যার কাছে
আশ্রয় খোঁজা যায়।
এমন একজন,
কঠিন সময়ে
যাঁকে অনুরোধ করা যায়
আমাদের বাঁচানোর জন্য। এবং
যাঁর মহত্ত্বের
ধারণা আমাদের বিবেককে, আমাদের চিন্তাকে বিস্মিত করে দেয়।
কিছু
বিশেষজ্ঞ
মনে করেন,
এই শব্দটি
এসেছে لَاهَ
يَلِيْهٌ
(লাহা ইয়ালিহু)
থেকে, যার
অর্থ হলো
‘মর্যাদায়
অনেক উঁচু‘
এবং ‘খালি
চোখে অদৃশ্য
থাকা‘। চিন্তা করে দেখুন এমন এক
সত্তা, যিনি এতটাই
মহান যে
তিনি আমাদের
দৃষ্টির আড়ালে, আমাদের
জাগতিক চোখের সীমানার
বাইরে।
এবার
আসুন, এই
শব্দটির আরেকটি শক্তিশালী
অর্থের দিকে যাই,
যা পুরো
ধারণাটাকেই
নাড়িয়ে দেয়।
কিছু
বিশেষজ্ঞ
বলেন, اَلَهِ
(আলাহ) মানে
হলো ‘সেই
ব্যক্তি দাসে পরিণত
হলো‘, আর
اَلَّهَهُ
(আল্লাহা’হু)
মানে হলো
‘সে তাকে
দাসে পরিণত
করলো বা
গোলাম বানালো‘। আর এখান
থেকেই এসেছে تَاْلِيْهٌ
(তা’লিহুন) বা تَعْبِيْدٌ
(তা’বিদ), যার অর্থ
হলো ‘গোলাম
বানানো‘ বা ‘দাসত্ব
করানো‘।
এই
দৃষ্টিকোণ
থেকে দেখলে,
إِلَهٌ
(ইলাহ) এমন
একটি শব্দ,
যা ব্যাকরণের
ভাষায় مَالُوْهٌ
(মা’লুহুন) এর অর্থ
দেয়। যেমন,
‘কিতাব‘ (বই) হলো
যা ‘মাকতুব‘
(লিখিত)। ঠিক সেভাবেই,
إِلَهٌ
(ইলাহ) হলেন
তিনি, যাঁকে
উপাসনা করা হয়,
যাঁর দাসত্ব
করা হয়।
তাহলে
এই অর্থে
إِلَهٌ
(ইলাহ) মানে
কী? এর
মানে হলো এমন এক
সত্তা, যাঁর শাসন
সবাইকে বাধ্যতামূলক
ভাবে মেনে
নিতে হবে,
যাঁর আইনকানুন
অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা এবং
মানা বাধ্যতামূলক।
এবার
চলুন কুরআনের
পাতায়। দেখুন, ফেরাউন
যখন মুসা
(আঃ)-কে
হুমকি দিচ্ছে, তখন সে
কী বলছে:
قَالَ
لَئِنِ
اتَّخَذْتَ
إِلَهًا
غَيْرِي
لَأَجْعَلَنَّكَ
مِنَ
الْمَسْجُونِينَ
(সূরা আশ-শু’আরা,
২৬:২৯)
"ফেরাউন বললো, ‘তুমি
যদি আমাকে
ছাড়া অন্য কাউকে
তোমার ইলাহ্
হিসেবে গ্রহণ করো,
তাহলে আমি অবশ্যই
তোমাকে কারাবন্দীদের
অন্তর্ভুক্ত
করবো‘।"
এখানে
ফেরাউন কি উপাসনার
কথা বলছে?
না! সে
বলছে ক্ষমতার
কথা, শাসনের
কথা। সে
বলছে, "এই রাজ্যে
আইন চলবে
আমার, শাসন
চলবে আমার।
আমাকে ছাড়া আর
কারও শাসন
যদি তুমি
মানো, তাহলে
তোমার পরিণতি হবে কারাগার।"
এখানে ‘ইলাহ্‘ মানে
হলো সর্বোচ্চ
ক্ষমতার অধিকারী, a Ruler.
একইভাবে,
আল্লাহ্
সুবহানাহু
ওয়া তা’আলা
আমাদের নিজেদের দিকে তাকাতে
বলছেন:
أَرَأَيْتَ
مَنِ
اتَّخَذَ
إِلَهَهُ
هَوَاهُ
(সূরা আল-ফুরকান,
২৫:৪৩)
"আপনি কি সেই
ব্যক্তিকে
দেখেছেন, যে তার
নিজের খেয়াল-খুশিকে,
নিজের কামনা-বাসনাকে
তার ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে?"
একটু থামুন এখানে। কী বলা
হচ্ছে? মানুষ তার
নিজের আবেগ, নিজের
প্রবৃত্তির
দাস হয়ে
গেছে। তার মন
যা চায়,
সে তাই
করে। তার
কাছে সেটাই
ঠিক, যা
তার ভালো
লাগে। তার জীবনের
চালক তার
নিজের ইচ্ছা। তাহলে সে
কার দাসত্ব
করছে? নিজের
প্রবৃত্তির।
তার জীবনের
‘ইলাহ্‘ কে? তার
নিজের ‘হাওয়া‘ বা খেয়াল-খুশি।
কতটা শক্তিশালী
একটি আয়াত!
এবার
দেখুন আল্লাহ্ নিজের সম্পর্কে
কী বলছেন:
وَهُوَ
الَّذِي
فِي
السَّمَاء
إِلَهٌ
وَفِي
الْأَرْضِ
إِلَهٌ
(সূরা আয-যুখরুফ,
৪৩:৮৪)
"এবং তিনিই
সেই সত্তা,
যিনি আসমানেও
ইলাহ্
এবং যমীনেও
ইলাহ্।"
এর
মানে কী?
তিনি আসমানেরও
উপাস্য, আবার পৃথিবীরও
উপাস্য। এবং তিনিই
আসমানেরও
শাসক, আবার
পৃথিবীরও
শাসক। এখানে উপাসনা
এবং শাসন দুটি অর্থই
একসাথে মিলে যাচ্ছে।
তাহলে
আমরা বুঝতে
পারছি, ‘ইলাহ্‘
শব্দটি শুধু ‘উপাস্য‘
নয়। এর
মানে ‘শাসক‘,
‘ক্ষমতার অধিকারী‘।
আরবের
মুশরিকরা
যখন সূর্য,
চন্দ্র বা অন্যান্য
শক্তিকে পূজা করত,
তারা এগুলোকে
শক্তিশালী
মনে করত।
তাই তারা
বলত اِلَاهَةٌ
(ইলাহাতুন),
অর্থাৎ চন্দ্র। আবার বলত
اِلَهَةٌ
(আলিহাতুন),
অর্থাৎ সূর্য। এভাবে, যে
কোনো কিছুর
উপাসনা করা হতো,
তাকেই ‘ইলাহ্‘ বলা
হতো। এমনকি তাদের
বানানো মূর্তিগুলোও
ছিল তাদের
‘ইলাহ্‘।
এখন
প্রশ্ন হলো, ‘আল্লাহ্’
শব্দটি কোথা থেকে
এলো?
একদল বিশেষজ্ঞ
মনে করেন,
‘আল্লাহ্’
একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ
শব্দ, যা
অন্য কোনো
শব্দ থেকে
আসেনি। কিন্তু অধিকাংশের
মতে, এই
শব্দটি আসলে ছিল
اَلْ
(আল) + اِلَهٌ
(ইলাহুন)। ‘আল‘ (ال) উপসর্গটি কোনো সাধারণ
নামকে নির্দিষ্ট
করে দেয়
(The)। যেমন, একটি বই
(a book) হলো ‘কিতাব‘,
আর সেই
বইটি (the book) হলো ‘আল-কিতাব‘।
তেমনি,
‘ইলাহ্‘ মানে হলো
‘কোনো একজন
উপাস্য বা শাসক‘।
কিন্তু যখন এর
সাথে ‘আল‘
যুক্ত হলো, তখন
এটি হয়ে
গেল ‘আল-ইলাহ্‘।
অর্থাৎ, ‘সেই একমাত্র
উপাস্য ও শাসক‘। আর এই ‘আল-ইলাহ্‘
শব্দটিই কালের বিবর্তনে
একীভূত হয়ে ‘আল্লাহ্’
(الله) শব্দে পরিণত হয়েছে।
সুবহানাল্লাহ!
তাহলে ‘আল্লাহ্’ হলেন সেই
একমাত্র সত্তা, যাঁর
মধ্যে ‘ইলাহ্‘-এর
সব অর্থ
পূর্ণরূপে
বিদ্যমান।
কুরআনে
‘আল্লাহ্’
শব্দটি সেই মহান
সত্তার পরিচায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই, আল্লাহ্
হলেন সেই
মহিমান্বিত
সত্তা, যিনি মানুষের
চোখ থেকে
অদৃশ্য, কিন্তু যাঁর বিশালতার
সামনে মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি
ও উপলব্ধি
সম্পূর্ণ
অক্ষম। তিনিই সেই
সত্তা, যিনি সমগ্র
মহাবিশ্বের
শাসন পরিচালনা
করেন এবং
যাঁর আনুগত্য
করা আমাদের
জন্য অপরিহার্য।
আর আমরা
তাঁর আনুগত্য
করতে পারি
কেবল তাঁরই
দেওয়া বিধান অনুযায়ী,
যা তিনি
ওহীর মাধ্যমে
আমাদের দিয়েছেন এবং যা
এখন পবিত্র
কুরআনের মাঝে সুরক্ষিত
আছে।
এজন্যই
যখন বলা
হয় آطِيْعُو
اَلله
(আতি’উল্লাহ),
এর মানে
দাঁড়ায় ‘আল্লাহ্র
আইনের অনুসরণ করো‘। ঠিক
সেভাবেই, এই মহাবিশ্বে
যা কিছু
ঘটে, তা
আল্লাহ্র
আইন অনুসারেই
ঘটে। দৃশ্যমান
জগৎ এবং
অদৃশ্য জগৎ (আলামুল
আমর ও আলামুল
খালক) সবই
তাঁর আইনের
অধীন। এই আইনগুলো
তিনি তাঁর
ইচ্ছা অনুযায়ী তৈরি করেছেন
এবং সেগুলো
তাঁরই নিয়ন্ত্রণ
ও কর্তৃত্বে
কাজ করে।
এটাই হলো
سُنَّةُ
الله
(সুন্নাতুল্লাহ) আল্লাহ্র
বিধান, যা অপরিবর্তনীয়।
পবিত্র
কুরআন হলো আল্লাহ্র
গুণাবলী, তাঁর আইন,
তাঁর আদেশ,
তাঁর কৌশল
এবং তাঁর
পথনির্দেশনার
সমষ্টি। তাঁর সমস্ত
শিক্ষার একটিই কেন্দ্রবিন্দু,
আর তা
হলো তাঁর
একত্ব বা ‘ওয়াহদানিয়াত‘।
এর মানে
হলো এই
মহাবিশ্বে
আল্লাহ্র
শাসন ছাড়া
আর কোনো
কিছুই সর্বোচ্চ নয়, চূড়ান্ত
নয়।
আর
তাঁর অবয়ব
বা আকৃতি
কেমন সেটা
আমাদের উপলব্ধির সম্পূর্ণ বাইরে। কারণ আমরা
সসীম, আর
কোনো সসীম
সত্তা অসীমকে পুরোপুরি ধারণ করতে
পারে না।
তবে, আমাদের
মানসিক সীমাবদ্ধতার
মধ্যে থেকেও আমরা
তাঁর
৯৯টি গুণবাচক
নাম থেকে
তাঁর সম্পর্কে
কিছুটা ধারণা পেতে
পারি।
কুরআন
অনুযায়ী,
সঠিক বিশ্বাস
বা ঈমান
সেটাই, যা কুরআনের
চাহিদা পূরণ করে।
যারা নিজেদের
মনগড়া ব্যাখ্যা অনুযায়ী আল্লাহ্কে
বিশ্বাস করে, কুরআনের
দৃষ্টিতে
তারা বিশ্বাসী
নয়। এই
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
এবং আমাদের
পরিষ্কারভাবে
বুঝতে হবে। আল্লাহ্র
ইবাদত এবং virtuous actions বা
নেক আমল
তখনই সঠিক
ও গ্রহণযোগ্য
হবে, যখন
তা বিভিন্ন
মানুষ, জাতি বা
ধর্মের চিন্তা অনুযায়ী না হয়ে,
একমাত্র কুরআনের দেখানো পথে হবে।
https://mafhoomulquran.com/