যখন তিনি (ﷺ) কথা বলেন, তখন তাঁর আবেগ-অনুভূতিকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়। তাঁর সামনে শুধু একটাই জিনিস থাকে: এই রাসূল (ﷺ) ওহী পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ব্যস, এটুকুই।
কিন্তু এখন আমরা এই আয়াতের মূল আলোচনায় আসি। আমি ভেবেছিলাম আয়াত নাম্বার ছয় পর্যন্ত যাবো, কিন্তু আমি আয়াত নাম্বার তিনে আটকে গেছি। আজ আমরা শুধু এটুকুই আলোচনা করব।
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ (আর তিনি নিজের প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না)।
আল্লাহ্ বলছেন, তারা… মানে, এভাবে ভাবুন। একজন বক্তা, কারণ নবীজি (ﷺ) এখন কুরআন তিলাওয়াত করছেন, তাই তিনি একজন বক্তা হয়ে উঠেছেন। একজন বক্তার প্রেরণা কী থাকে? তারা চায় মানুষ তাদের কথা শুনুক, স্বীকৃতি দিক। তাদের ধারণাগুলো যেন মানুষের কাছে পৌঁছায়। কেউ যখন একটা বই প্রকাশ করে, তার আকাঙ্ক্ষা কী থাকে? ‘ইনশাআল্লাহ, আমার বইটা একদিন লাইব্রেরিতে ধুলো জমাবে।’ না, তার আকাঙ্ক্ষা থাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বই পড়বে। কেউ যখন পিএইচডি থিসিস লেখে, তারা আসলেই কী আশা করে? মানুষ যেন এটা পড়ে।
আপনি যখন আপনার খাওয়া পিজ্জার একটা স্লাইস নিয়ে বোকার মতো একটা পোস্ট দেন আর তার সাথে চিজ নিয়ে আপনার গভীর চিন্তা-ভাবনা জুড়ে দিয়ে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন, তখন আপনি বারবার কী চেক করেন? স্বীকৃতি। কেউ এসে বলবে, ‘ওহ মাই গড, কী গভীর কথা! আমি আর কখনো আগের মতো পিজ্জা খেতে পারবো না’… ইত্যাদি, ইত্যাদি।
কারণ একজন বক্তা, একজন উপস্থাপক যখন জনসমক্ষে তার ধারণা তুলে ধরে, সে স্বীকৃতি চায়। সে চায় মানুষ তার কথা শুনুক, তাকে বুঝুক। হয়তো সে প্রশংসা চায়। হয়তো চায় মানুষ তাকে গুরুত্ব দিক, মূল্য দিক। ‘ওয়াও, কী অসাধারণ প্রতিভা!’ হয়তো সে একটা সামাজিক অবস্থান চায়, ‘আমি আপনার কাছ থেকে আরও শিখতে চাই।’ হয়তো সে এটাই চায়। কথার পেছনে অনেক আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে থাকে।
যেমন আমি যদি এখানে বসে আপনাদের লেকচার দিই আর আপনাদের মধ্যে দুজন কথা বলতে শুরু করেন, আমার খারাপ লাগবে। আমার রাগ উঠবে, কারণ আমি এই মুহূর্তে চাই আপনারা আমার কথা শুনুন। আর আপনারা সেটা হতে দিচ্ছেন না। এটা আমাকে বিরক্ত করবে কারণ আপনারা যা করছেন, তা সরাসরি আমার ওপর প্রভাব ফেলছে, তাই না?
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বর্ণনা করা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। যখন তিনি কথা বলেন, তাঁর মনে কারো শোনার আকাঙ্ক্ষা নেই, স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই, প্রশংসা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নেই, এমনকি কেউ তাকে অনুসরণ করুক—এমন আকাঙ্ক্ষাও নেই। তিনি শুধু একারণেই এটা করছেন কারণ আল্লাহ্ তাঁকে করতে বলেছেন। তাঁর কোনো ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা আবেগ, সচেতন বা অবচেতনভাবে, এর সাথে জড়িত নয়।
এটা হলো একনিষ্ঠতার এক অবিশ্বাস্য প্রকাশ, যেন এক মিলিয়ন পার্সেন্ট খাঁটি ইখলাস। কারণ এটা এমন এক স্তরের বিশুদ্ধতা, যা আমাদের বাকিদের জন্য অর্জন করা আদৌ সম্ভব কি না, আমি জানি না। সত্যিই জানি না। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে পারি। যখন কুরআনের কথা আসে, কারণ এই আয়াতটি কুরআন পৌঁছে দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত, তখন তিনি বলেন:(আমার নিজের থেকে এটা পরিবর্তন করার কোনো অধিকার নেই)। নবীজি (ﷺ) নিজে সিদ্ধান্ত নেন না কোন শব্দগুলো বের হবে।
আর বেশিরভাগ সময়ই যে শব্দগুলো বের হতো, সেগুলো ছিল আক্রমণাত্মক। যখন কেউ রেগে আছে, তখন পরের আয়াতটা আরও বেশি আক্রমণাত্মক শোনায়। তখন তারা আরও রেগে যায়, আর তার পরের আয়াতটা আরও বেশি আক্রমণাত্মক। আর এর উপরে যদি বলা হয়, ‘আর জেনে রাখো, তোমরা জাহান্নামে যাবে। আর অভিনন্দন সেই বিশ্বাসীদের যারা মার খাচ্ছে।’ ওহ মাই গড! আমার মনে তখন হয়তো আসতো—আমি হলে হয়তো ভাবতাম—‘আমার মনে হয় এটা এখন বলা ঠিক হবে না। হয়তো এই সূরাটা আমি পরে পড়বো, যখন আশেপাশে কেউ থাকবে না, অথবা যখন কম প্রতিকূল একটা ভিড় থাকবে, তখন পড়বো।’
এখন আমি আপনাদের সামনে সূরা আন-নাজম ব্যাখ্যা করছি, কিন্তু আপনারা সবাই স্বেচ্ছায় শুনছেন। আপনারা সময়, টাকা, শ্রম ব্যয় করে, পরিবার থেকে দূরে এসে এখানে বসেছেন শোনার জন্য। আপনারা কি মনে করেন নবীজি (ﷺ)-এর পরিস্থিতি এমন ছিল? তাঁর সামনে থাকতো একদল মুশরিক, নাস্তিক, বস্তুবাদী, ইসলাম-বিরোধী, স্বৈরাচারী, নার্সিসিস্ট, আর তিনি তাদের সামনে কুরআন তিলাওয়াত করছেন, আর তারা গোলমাল করছে। তিনি কি থেমে যেতেন? তিনি কি বলতেন, ‘আমার হয়তো আরও আগ্রহী শ্রোতাদের কাছে যাওয়া উচিত?’ না, পরিষ্কারভাবে, وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ (তিনি নিজের প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না)। তিনি কুরআন পৌঁছে দিচ্ছেন, ফলাফল যা-ই হোক না কেন। তিনি ভিউয়ারশিপ, ফলোয়ার বা কমেন্টস নিয়ে চিন্তিত নন।
আমাদের বেশিরভাগই যখন অনলাইনে কিছু পোস্ট করি, আপনি বক্তা হন বা না হন, আপনি কিছু পোস্ট করলে কী চেক করেন? কমেন্টস। এমনকি আপনি যদি অন্য কারো খুতবা বা লেকচারও শোনেন, আপনি লেকচার শোনেন না, আপনি শুধু ‘মাশাআল্লাহ’ কমেন্টগুলো দেখতে দেখতে এমন কাউকে খুঁজে বেরান যে বক্তাকে ট্রল করেছে। ‘দেখো, ও কী বলেছে! ওহ মাই গড!’ আপনি এটাই করেন। আমরা মন্তব্য নিয়ে এতো বেশি আচ্ছন্ন।
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ (তিনি নিজের প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না)—এর প্রথম অর্থ হলো, তিনি তার প্রতিভা পৃথিবীকে দেখানোর জন্য মরিয়া নন। যেমন একজন দার্শনিক তার দর্শন শেয়ার করার জন্য মরিয়া থাকেন। একজন গায়ক তার গান গাওয়ার জন্য ছটফট করেন। একজন গল্পকার তার গল্প বলার জন্য উতলা হয়ে থাকেন। নবীজি (ﷺ) এমন নন যে, ‘ওহ মাই গড, আমার ভেতরে যা আছে তা পৃথিবীকে জানাতেই হবে।’ না, না, না। আল্লাহ্ তাঁকে এটা দিয়েছেন। এটা তাঁর নিজের অহমের প্রতিফলন নয়, যেমনটা অন্য সব বক্তার ক্ষেত্রে হয়। এটা তেমন নয়।
আর তার উপরে, একজন বক্তা কিন্তু ফিডব্যাক খুব মন দিয়ে শোনে, তাই না? ‘এই কবিতাটা দারুণ হিট হয়েছে। ওটা তেমন চলেনি। এই ভাষণটা খুব ভালো গেছে, ওইটা যায়নি। এখন আমাকে আমার স্টাইল বদলাতে হবে শ্রোতাদের মনমতো করার জন্য, কারণ আমাকে আমার অডিয়েন্স ধরে রাখতে হবে।’ আর এখন তো এটা মাল্টি-বিলিয়ন, ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। কীভাবে আপনি অডিয়েন্স তৈরি করবেন? কীভাবে আপনার বার্তা শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য আরও ভালোভাবে সাজাবেন? সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিক্স কি এটাই নয়? মানুষ কি এখন এটা নিয়েই ডিগ্রি করছে না? মার্কেটিং ডিগ্রি, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যানালিটিক্স ডিগ্রি, আর ট্রেন্ড ও আচরণ নিয়ে গবেষণা—এসব কিসের জন্য? এনগেজমেন্ট পেতে, ভিড় জমাতে, অডিয়েন্স পেতে।
আর আল্লাহ্ এই সবকিছুর ওপর যেন এক বালতি অ্যাসিড ঢেলে দিলেন। শুধু এই কথা বলে যে, তিনি (নবী ﷺ) মানুষ কী শুনতে চায় তা নিয়ে চিন্তিতই নন। তিনি এসব নিয়ে ভাবেনই না।
আমি আপনাদের একটা ব্যক্তিগত কথা বলে শেষ করছি। এটা আমি আপনাদের সামনে বলছি, কিন্তু আপনারা এটা নিজেদের জন্য নিতে পারেন। যখন আমি ‘কুরআন উইক’—এই প্রোগ্রামটা তৈরি করছিলাম, এর আগে যখন আমি ভ্রমণ করতাম, তখন আমি ‘স্টোরি নাইট’ নামে আরেকটি প্রোগ্রাম করতাম। আর ‘স্টোরি নাইট’ ছিল আমার ভেতরের জমে থাকা কমেডিয়ান হওয়ার ইচ্ছা, যা কুরআনের মুখোশে ঢাকা। আমি ‘স্টোরি নাইট’-এ খুব মজা পেতাম। আমি গল্প বলতে ভালোবাসি। এই যে অ্যাকাডেমিক, গিকি ব্যাপারগুলো—এটা আমার একটা দিক। আমার আরেকটা দিক আছে, যা এর ঠিক উল্টো। সেটা পুরোপুরি বোকার মতো। আর সেই দিকটাই ‘স্টোরি নাইট’-এ বেরিয়ে আসতো। আর আমি সত্যিই… এটা মাত্র তিন ঘণ্টার প্রোগ্রাম, খুবই মজার, বাচ্চারা আসতো, তারা খুব মজা পেত। অমুসলিমরাও এসে উপভোগ করতো। এটা সহজ, কোনো কঠিন কাজ নয়। এটা অটো-পাইলটে চলতো। আমার কিছুই করতে হতো না।
আর তারপর আমি ভাবলাম, চলো বিভিন্ন কমিউনিটিতে যাই আর কুরআনের একটি পুরো সূরা নিয়ে তাদাব্বুর (গভীর বিশ্লেষণ ) করি। আর জানেন আমার টিম কী বলেছিল? ‘কে আসবে এসব শুনতে? মানুষ এর জন্য প্রস্তুত নয়। মানুষের তো এখন টিকটক অ্যাটেনশন স্প্যান, ৯০ সেকেন্ডের পর আর মনোযোগ থাকে না। না, ৯০ সেকেন্ডও বেশি, ৩০ সেকেন্ড। প্রথম দিনই তারা আপনাকে সোয়াইপ করে সরিয়ে দিতে চাইবে। মানুষ বলবে, আমি আর এখানে আসছি না। এটা অনেক বেশি। অনেক বেশি পড়ার জিনিস। এটা অনেক গভীর, অনেক ভারী। সাধারণ মানুষ এটা চায় না।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। কিন্তু সমস্যা হলো কুরআনের তাদাব্বুর মরে যাচ্ছে। আমরা জাতি হিসেবে এটা করছি না।’ আর আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল—আপনাদের মধ্যে একজন আসুক বা কেউই না আসুক, আমি কুরআনের তাদাব্বুর করবোই। আর আমি যদি একটা কমিউনিটিতে মাত্র একজন মানুষকেও কুরআনের তাদাব্বুর শুরু করতে উৎসাহিত করতে পারি, তাতেই আমি খুশি।
আমি বায়্যিনাহ ক্যাম্পাসে ক্যামেরার সামনে বসেও এটা করতে পারতাম। আমি সূরা ইউসুফ, সূরা আল-কাহফ, সূরা আলে-ইমরান সেভাবেই করেছি। কিন্তু আমি ভাবলাম, না, আমি ভ্রমণ করতে চাই আর এই কঠিন কাজটা নিজের সাথে বয়ে নিয়ে যেতে চাই। আমার একটা মানসিক বাধা ছিল যে, ‘আমার মনে হয় না এটা সফল হবে, কারণ এটা আকর্ষণীয় প্রোগ্রাম নয়, কারণ এতে অনেক বেশি পরিশ্রম।’
আর তখনই এই ধরনের আয়াতগুলো এসে মুখের ওপর একটা চপেটাঘাত করে। ‘তো কী হয়েছে যদি এটা আকর্ষণীয় না হয়? তো কী হয়েছে যদি এটা টার্গেট অডিয়েন্সের মনমতো না হয়? তো কী হয়েছে যদি এটা ভাইরাল না হয়? ওটা তো তোমার লক্ষ্য নয়। ওটা তোমার লক্ষ্য নয়।’ আমাকে নিজেকে এমন পর্যায়ে পরিশুদ্ধ করতে হবে যেখানে আপনাদের মধ্যে দুজন বসে থাকুন, ২০০ জন বসে থাকুন, বা ২,০০০ জন বসে থাকুন—কোনো পার্থক্য তৈরি হবে না। সেদিন আমি বুঝবো যে আমি وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ থেকে কিছু একটা শিখেছি।
যখন তিনি কথা বলেন, তাঁর আবেগ-অনুভূতিকে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়। তাঁর সামনে শুধু একটাই জিনিস থাকে: এই রাসূল (ﷺ) ওহী পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ব্যস, এটুকুই। সেই কথা কারো হৃদয়ে পৌঁছালো কি না, তিনি জানেন সেটা তাঁর হাতে নেই। কারণ হৃদয়ে যা প্রবেশ করে, তা আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে। নইলে এগুলো তো শুধুই কিছু শব্দতরঙ্গ। সেগুলো পৌঁছাবে কি পৌঁছাবে না, তা আমাদের হাতে নেই। বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ (আর তিনি নিজের প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না)—এর ভেতরে এটা এক অবিশ্বাস্য, অসাধারণ বার্তা।
সবশেষে লক্ষ্য করুন, هَوَىٰ (হাওয়া) শব্দটি—যার অর্থ শূন্যতা, পতন—বারবার এসেছে।
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَىٰ (শপথ তারকার, যখন তা অস্ত যায় বা পতিত হয়)।
مَا ضَلَّ صَاحِبُكُمْ وَمَا غَوَىٰ (তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হয়নি এবং বিপথগামীও হয়নি)।
وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ (আর তিনি নিজের প্রবৃত্তি বা কামনা থেকে কথা বলেন না)।
শুরুতে তারকা পতিত হয়। কিন্তু নবীজি (ﷺ) পতিত হন না। তারকা খসে পড়তে পারে, কিন্তু এই বার্তা পতিত হয় না। প্রথম আয়াত এবং তৃতীয় আয়াতে هَوَىٰ (হাওয়া) শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে একটা বৈপরীত্য তৈরি করা হয়েছে।
আমি এই সপ্তাহটা নিয়ে খুবই উত্তেজিত। আমি জানি না আমি সূরা আন-নাজম শেষ করতে পারবো কি না। সত্যি জানি না। যদি শেষ করতে না পারি, আমি EPIC-কে অনুরোধ করবো অতিরিক্ত দিন নিয়ে এটা শেষ করার জন্য। আর যদি আপনাদের কেউই আসতে না পারেন, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি ইনশাআল্লাহ এসে এটা শেষ করবোই। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা পারবো। ইনশাআল্লাহ আমরা পারবো। আমার ইচ্ছা, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আয়াত নাম্বার ১৮ পর্যন্ত পৌঁছানো। এটাই প্রথম অংশ। আমি জানি যে এই তিন আয়াত নিয়েই এতো সময় লেগে গেল, তাই আপনারা হয়তো ভাবছেন, ‘উনি ভাবছেন উনি ১৮ পর্যন্ত পৌঁছাবেন!’ হয়তো। চলুন আশা রাখি। যেহেতু আমি আপনাদের জন্য ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছি, এখন হয়তো বিষয়গুলো আরেকটু দ্রুত এগোবে।
কিন্তু শেষ করার আগে, আমি আপনাদের জানাতে চাই যে আপনাদের যে বুকলেটগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো কীভাবে কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর বা গভীর বিশ্লেষণ করতে হয় সে বিষয়ে। আমি আপনাদের প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু বিষয় দেবো। আর সেই দৃষ্টিকোণ শুরু করার আগে একটা জিনিস আছে যেটাকে আমরা বলি ‘হৃদয়ের ফিল্টার’। আমি শুরুতে আপনাদের এটা নিয়ে বলেছিলাম। আমি আবারও বলবো। এটা আপনাদের কাছে আছে। তাদাব্বুর করার আগে আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে, আবেগগতভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। তাফসীরের জন্য আমাকে জ্ঞানগতভাবে প্রস্তুত হতে হয়। মনে আছে, যখন আমি কোনো শব্দের তাফসীর করছিলাম, সেখানে আরবী সূত্র, সাহাবা, তাবেঈনদের উক্তি ইত্যাদি ছিল? ওটা ছিল জ্ঞানগত কাজ। কিন্তু তাদাব্বুরের জন্য আপনার মস্তিষ্ক নয়, আপনার কী প্রয়োজন? আপনার হৃদয়।
এর পূর্বশর্তগুলো আমার হৃদয়ে থাকতে হবে। প্রথম পূর্বশর্ত হলো: আল্লাহর বাণী নিখুঁত এবং আমার বোঝা নিখুঁত নয়। এর মানে হলো, যখন আমি কিছু পড়ি আর আমার কাছে সেটা অর্থহীন মনে হয়, তার কারণ হলো আমার বোধশক্তি যথেষ্ট প্রশস্ত নয়, আর আল্লাহর প্রজ্ঞা অসীম। আমাকে আল্লাহর বাণীর সামনে নিজেকে বিনীত করতে হবে। এটা তাদাব্বুরের সবচেয়ে কঠিন পূর্বশর্তগুলোর একটি, কারণ আমরা এক সমালোচক সমাজে বাস করি। আপনি যে বার্তাই পান, তার সমালোচনা করেন। আপনি তাতে হার্ট দেন, থাম্বস আপ দেন, থাম্বস ডাউন দেন। আপনি তার ওপর মন্তব্য করেন। আপনি কলেজে কোর্স নেন, আপনার প্রফেসরকে রেটিং দেন। আপনি ভাষণ শোনেন, তাকে রেটিং দেন। মানুষ এখন খুতবাকেও রেটিং দেয়।
এটা এমন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি একবার একটা খুতবা দিয়েছিলাম। এক ভাই আমার কাছে এসে বললেন, ‘খুব ভালো ছিল। কিন্তু আপনি যদি এই আয়াত আর এই আয়াতটা ব্যবহার করতেন, তাহলে আরও ভালো হতো।’ আমি ভাবলাম, ‘বাপরে, এটা তো ‘আমার-খুতবাকে-রেটিং-দিন-ডট-কম’ হয়ে গেলো?’ আমি তো কোনো স্কোর চাইনি, ভাই।
কিন্তু আমরা এখন ইসলামকেও রেটিং দিচ্ছি। আপনার প্রিয় বক্তা কে? আপনি তাকে কত স্কোর দেবেন? এই বোকামি বন্ধ হতে হবে। এই অর্থহীনতা বন্ধ হতে হবে। বাচ্চারা আগে অ্যাথলেটদের জন্য, বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের জন্য এটা করতো। মানুষ ইউএফসি ফাইটারদের জন্য এটা করে। আর এখন আপনারা শাইখদের জন্য এটা করছেন। এটা কী? এটাই কি এখন ধর্ম? আমরা ধর্মকে এই ছাঁচে ফেলে দিয়েছি। কেন? কারণ আমাদের হৃদয় যা চায়, তা বার্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। তাই যদি কোনো বক্তার উচ্চারণে টান থাকে, বা বক্তা আকর্ষণীয় না হন, বা বক্তা খুব বয়স্ক হন, আপনি বলেন, ‘আমি মনোযোগ দিতে পারছি না। এটা যথেষ্ট বিনোদনমূলক নয়। এটা আমাকে সেই অনুভূতিটা দেয় না। তাঁর ভাষণে কোনো কৌতুক নেই।’
হ্যাঁ, নেই। আমি যাদের কথা শুনি, তারা খুবই বোরিং। কিন্তু আমি তাদের ভালোবাসি। আমাকে প্রতি পাঁচ-সাত মিনিট পর পর থামতে হয়, কারণ আমার চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু আমি তাদের শুনি, কারণ আমি তাদের কাছ থেকে অন্য যেকোনো কিছুর চেয়ে বেশি উপকৃত হই।
কুরআন আপনার মনোরঞ্জনের জন্য আসেনি, কারণ এটা আপনার মালিকের কাছ থেকে এসেছে। মালিক কখনো গোলামের মন জোগায় না। বরং গোলামকেই মালিকের মন জোগিয়ে চলতে হয়। কুরআনের কাছে আসার সময় এই মনোভাবের পরিবর্তন প্রয়োজন। এটাই আমার হৃদয়ের ফিল্টার। আমি সমালোচকের মতো এর কাছে আসতে পারি না। আমি এটাকে অ্যামাজনের পণ্যের মতো ভাবতে পারি না যে, ‘আমি এটাকে আড়াই স্টার দিলাম।’ এভাবে নয়।
কুরআনে আমার দ্বিতীয় ফিল্টার হলো—আমি কিছু একটা খুঁজছি। আমি হিদায়াত খুঁজছি। আমি তথ্য খুঁজছি না। তথ্য আমি পাবো, কিন্তু লক্ষ্য তথ্য ছিল না। লক্ষ্য ছিল কী? হিদায়াত।
আজকে আপনাদের বাড়ির কাজ, এই তিনটি আয়াত। আমরা শুধু তিনটি আয়াত পড়েছি। আপনাদের বাড়ির কাজ হলো, এই তিনটি আয়াত থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে কী হিদায়াত পাচ্ছি? আমি কী শিখলাম এই তিনটি আয়াত থেকে? আমি আপনাদের সাথে কিছু তাফসীরি মন্তব্য শেয়ার করেছি। আমি এর অর্থ বুঝিয়েছি, শব্দভান্ডার নিয়ে আলোচনা করেছি। ওগুলো ছিল তাফসীর। এখন আমাদের কী করতে হবে? তাদাব্বুর। এর মানে আমার জন্য কী? আমি وَمَا يَنطِقُ عَنِ الْهَوَىٰ থেকে কিছু তাদাব্বুর আপনাদের সাথে শেয়ার করেছি, কিন্তু আপনার নিজেরও তাদাব্বুর থাকতে হবে। আপনাকে এই কাজটা করতে হবে।
এটা আল্লাহ্ আপনার সাথে কথা বলছেন। আল্লাহ্ আমার সাথে কথা বলছেন। একজন খুব সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছিলেন, আর এটা বলেই আমি শেষ করবো। তিনি বলেছিলেন, ‘সাহাবাদের এতো ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল কেন? আর তারা কেন আমাদের বলে যাননি যে নবীজি (ﷺ) কুরআন সম্পর্কে কী বলেছেন? তাহলে তো আরও সহজ হতো।’
ব্যাপারটা হলো, আল্লাহ্ এই কুরআনকে এক অসাধারণ উপায়ে ডিজাইন করেছেন। তিনি বলেননি, ‘যাতে নবীজি (ﷺ) এর ওপর চিন্তা করেন।’ তিনি বলেছেন,(যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে)। لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (যাতে তোমরা বুঝতে পারো)। আয়াতগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা, গভীর চিন্তা করা, অবাক হওয়া—এই কাজগুলো কার করার কথা ছিল? আমাদের।
আমার তত্ত্ব হলো, যদি নবীজি (ﷺ) কুরআনের তাফসীর করা শুরু করতেন, তিনি এখনও জীবিত থাকতেন। কারণ এতে এতো প্রজ্ঞা আছে, আল্লাহ্ তাঁকে নূহ (আ.)-এর চেয়েও বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতেন, কারণ তাফসীর শেষ হতো না। আর যদি তিনি কুরআনের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত তাফসীরও করতেন—প্রতিটি আয়াতের জন্য একটি হাদীস বর্ণনা করতেন—তাহলেও কী হতো জানেন? কেউ আর কখনো কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করতো না। জানেন কেন? কারণ আমরা বলতাম, ‘নবীজি (ﷺ) বলার পর আমি কীভাবে কথা বলি? আমার এ বিষয়ে কোনো চিন্তা থাকতে পারে না, কারণ চিন্তা তো চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এসেছে, নবীজি (ﷺ) নিজে, যিনি আল্লাহর অনুমোদিত শিক্ষক।’
আল্লাহ্ আমাদের এই কুরআন দিয়েছেন এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর বলেছেন, এই আয়াতগুলো তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করবে। ভাবুন তো, প্রথম শতাব্দীতে, নবীজি (ﷺ)-এর ১০ বছর পর, মানুষ আবিসিনিয়া, চীন, ভারতে পৌঁছে গেছে। তারা সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই মানুষগুলো যখন কুরআনের আয়াত শুনছিল, তারা কি বলছিল, ‘এটার সাথে কোনো তাফসীর আছে? আমি পড়তে পারি?’ তারা কী করছিল? তারা আয়াতগুলো শুনছিল আর কী করছিল? তারা তাদাব্বুর করছিল। আর যখন তারা তাদাব্বুর করছিল, তারা ইসলাম গ্রহণ করছিল। আর তাদের ইসলাম গ্রহণের ফলেই আমরা মুসলিম হয়েছি।
আমরা কী করেছি, আমরা তাদাব্বুরকে তাফসীর দিয়ে পাল্টে ফেলেছি। আর তারপর আমরা বলেছি, ‘তাফসীর শুধু আলেমদের জন্য। তোমার জন্য নয়।’ অবশ্যই, তাফসীর লেখা আলেমদের কাজ। আর আমার কাজ হলো তা পড়া এবং তারপর তাদাব্বুর করা। কিন্তু আমরা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কুরআনের সাথে সংযোগ স্থাপন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আমি পাকিস্তান থেকে এসেছি। আর দক্ষিণ এশিয়ায় কুরআনের ব্যাপারে সবচেয়ে সাধারণ যে কথাটা শোনা যায় তা হলো, ‘সরাসরি পড়ো না। অনুবাদ পড়ো না। এটা নিয়ে ভেবো না। তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’ আর আমি বলি, যে কিতাব মানবজাতিকে পথ দেখাতে এসেছে, আর আপনার ধর্মীয় উপদেশ হলো, ‘এটা নিয়ে ভেবো না, কারণ তুমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে!’ অবিশ্বাস্য! এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য!
যারা জানে, তাদের কাজ হলো যারা জানে না তাদের জন্য বিষয়টাকে সহজ করে দেওয়া। এটাই আমাদের কাজ। আর আমরা এখন কী করি? ‘না, না, না। আমরা তোমার কাছে যাবো না। তোমাকেই আমাদের কাছে আসতে হবে।’ আমরা বার্তা পৌঁছে দেওয়ার এই নিয়মটাই উল্টে দিয়েছি।
আমি চাই আপনারা প্রত্যেকে কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করার একটা ভালোবাসা তৈরি করুন। আর আপনারা জীবনে এর এমন উপকারিতা দেখবেন যা কখনো কল্পনাও করেননি। কখনো না। আমি আপনাদের বলছি, এটা আপনার জীবনের সবচেয়ে পরিপূর্ণ কাজ হবে, আমার জীবনের সবচেয়ে পরিপূর্ণ কাজ হলো কুরআন নিয়ে তাদাব্বুর করা।
জানেন, আমার কাছে তাফসীর পড়াটা খুব ক্লান্তিকর মনে হয়। কিন্তু যখন তাফসীর পড়া শেষ হয় আর আমি তাদাব্বুর শুরু করি, উফফ, এর মতো আর কিছুই নেই! পৃথিবীর সেরা কাজ। এটা পৃথিবীর সেরা কাজ! আমি স্কটল্যান্ডে শাইখ সোহাইবের সাথে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় পড়ছিলাম। আমরা পাঁচ ঘণ্টা ধরে শুধু তাদাব্বুর করছিলাম আর আমাকে মাঝখানে থেমে বলতে হয়েছিল, ‘এটা কি এই গ্রহের সবচেয়ে অসাধারণ কাজ নয়?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, কাউকে বলো না।’ আমি বললাম, ‘আমি বলবো!’
আমি চাই আপনারা সবাই সেই আনন্দটা পান। আল্লাহ্ বলেন,(কুরআনের কারণে তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। তারা যা কিছু জমা করে, তার চেয়ে এটা উত্তম)।
চলুন আমরা কিছু কুরআন জমা করি। এই কথা বলে আমি আমাদের প্রথম সেশন শেষ করছি। আমার মনে হয় এটা বেশ ভালোই হয়েছে। ইনশাআল্লাহ, যদিও সেটা আপনাদের ওপর নির্ভর করে। আমি আপনাদের কমেন্টস নিয়ে ভাবি না, তবে বাড়ির কাজটা অবশ্যই করবেন। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল আপনাদের সবার সাথে দেখা হবে।