সুরা আন নাজম ( পর্বঃ১১)

Spread the love

এখন সেই আয়াতটির অনুবাদ:
“مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَءَىٰ”
"হৃদয় মিথ্যা বলেনি সে যা দেখেছে।"
একটা অদ্ভুত বাক্য। কারণ হৃদয় তো দেখে না, চোখ দেখে, তাই না? কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে, হৃদয় দেখেছে। আমি চাই আপনি এখানে একটা ব্যাপার বুঝুন—কুরআন আপনাকে বাস্তবতার এক ভিন্ন রকমের দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে। এখানে বাস্তবতা দুই রকমের: একটা দৃশ্যমান বাস্তবতা (Seen Reality) এবং অন্যটা অদৃশ্য বাস্তবতা (Unseen Reality)।Physics একে বলে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ বা সপ্তম ডাইমেনশন। Quantum Physics এখন এ সম্পর্কে আলোচনা করে এবং একে "dimensions" বলে।
কিন্তু আমরা তো বরাবরই একে "الغيب" (আল-গাইব) বলে আসছি। একটা অদৃশ্য জগৎ আছে। আর সেই জগতে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের নিয়ম—যেগুলো এখানে কাজ করে—সেগুলো সেখানে কাজ করে না। ওটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগৎ, আপনি বুঝতে পারছেন তো?
যেমন এই দৃশ্যমান জগতে আলোর গতি হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুত, এবং তা এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছাতে বিলিয়ন বছর লেগে যায়। কিন্তু অদৃশ্য জগত থেকে জিবরীল আঃ মুহূর্তেই চলে আসতে পারেন। চোখের পলকে হাজির হয়ে যেতে পারেন। তাহলে বুঝলেন তো? অদৃশ্য জগত যেভাবে কাজ করে, সেটা দৃশ্যমান জগতের মতো না। আল্লাহ মানুষকে বানিয়েছেন দুই ভাগে—একটা দৃশ্যমান অংশ, আরেকটা অদৃশ্য অংশ। আমার শরীর দৃশ্যমান। ECG স্ক্যান বা অন্যান্য টেকনোলজি আমার শরীরের ভেতরের সিস্টেমগুলো দেখাতে পারে—যেগুলো দৃশ্যমান।
কিন্তু আমার ভেতরে এমন কিছু আছে যা কোনো স্ক্যান দেখাতে পারে না। সেটা হলো "الروح" (আর-রূহ)—আমার আত্মা, আমার আধ্যাত্মিক হৃদয়। যখন আমি বলি "হৃদয়", তখন আপনার মনে একটা ছবি আসে—জীববৈজ্ঞানিক হৃদয়ের ছবি, যেটা রক্ত পাম্প করে। কিন্তু এটাই তো একমাত্র হৃদয় না। আছে আরেকটি হৃদয়—অদৃশ্য হৃদয়—যেটা এই দেহগত হৃদয় নয়।
এই রকম করে, যেমন:
• আছে দৃষ্টিশক্তি—এই চোখদুটো।
কিন্তু আছে আধ্যাত্মিক চোখ (Spiritual eyes)।
• আছে কান—শরীরগত শ্রবণ।
কিন্তু আছে আধ্যাত্মিক শ্রবণ (Spiritual ears)।
• আছে হৃদয়—এই রক্ত পাম্প করা হৃদয়।
কিন্তু আছে আধ্যাত্মিক হৃদয় (Spiritual heart)।

 

কুরআন অনেক সময় এই আধ্যাত্মিক হৃদয় সম্পর্কে বলছে।
যেমন, আল্লাহ বলেন:
"ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِىَ كَٱلْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً"
"তোমাদের হৃদয়গুলো কঠোর হয়ে গেল, পাথরের মতো বরং তার চেয়েও কঠিন।"
কেউ বলবে, "উস্তাদ, কারো হৃদয় পাথরের মতো হলে তো মারা যাবে!"
হ্যাঁ, ওদের হৃদয় তখনও নরমই ছিল—জীববৈজ্ঞানিকভাবে। কিন্তু আল্লাহ তো শরীরগত হৃদয় সম্পর্কে বলছেন না। বলছেন আধ্যাত্মিক হৃদয় সম্পর্কে।

 

এই শরীরগত হৃদয় রক্ত পাম্প করে। ঠিক আছে। কিন্তু আল্লাহ বলেন:
"لَهُمْ قُلُوبٌ لَا يَفْقَهُونَ بِهَا"
"তাদের হৃদয় আছে, কিন্তু তারা তা দিয়ে বোঝে না।"
আপনি বলবেন, "আরে বুঝার কাজ তো মস্তিষ্কের, হৃদয় দিয়ে কেন?"
এই জন্য অনেকে বলে কুরআন বিজ্ঞানসম্মত না। আপনি ঠিকই ধরেছেন—কুরআন বিজ্ঞানসম্মত নয় শুধু, কুরআন আধ্যাত্মিকও। আপনি যদি কুরআনকে বিজ্ঞান বই হিসেবে পড়েন, তাহলে আপনি সমস্যায় পড়বেন। কারণ আপনি একমাত্র দৃশ্যমান জগত দেখছেন। কিন্তু কুরআন কথা বলছে দুই জগত নিয়ে—দৃশ্যমান ও অদৃশ্য।

তাই আল্লাহ বলেন:
"لَهُمْ أَعْيُنٌ لَا يُبْصِرُونَ بِهَا"
"তাদের চোখ আছে, কিন্তু তারা দেখে না।"
কিন্তু ওরা তো দেখে। আবু জাহল, আবু লাহাব—ওরা তো নবীজিকে দেখেছে।
তবুও আল্লাহ বলেন, "তাদের চোখ আছে, কিন্তু তারা দেখে না।" মানে কোন চোখ? আধ্যাত্মিক চোখ। তাদের কান আছে, কিন্তু তারা শোনে না। তবে কুরআনের আওয়াজ তো কানে যায়, তারা তো শব্দ শুনে। কিন্তু তারা আধ্যাত্মিকভাবে শোনে না।

এখন শুনুন, এই আধ্যাত্মিক হৃদয়, চোখ, কান—সবকিছু আসলে হৃদয় থেকেই উদ্ভূত। যখন কারো হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, তখন সে কিছুই শোনে না, কিছুই দেখে না।
তাই আল্লাহ বলেন:
"خَتَمَ ٱللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ وَعَلَىٰ سَمْعِهِمْ وَعَلَىٰٓ أَبْصَـٰرِهِمْ غِشَـٰوَةٌ"
"আল্লাহ তাদের হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন, শ্রবণ মোহর করে দিয়েছেন, দৃষ্টিও আবৃত করে দিয়েছেন।" অর্থাৎ, মোহর মূলত হৃদয়ের ওপর। আর হৃদয় যখন সিল হয়ে যায়, তখন শ্রবণ আর দর্শন কোনো উপকারে আসে না। নবীজী ﷺ একই সাথে দৃশ্যমান জগত ও অদৃশ্য জগত অনুভব করতেন। আমরা পারি না। আমাদের সামনে বহু পর্দা। কিয়ামতের দিনে আল্লাহ এই পর্দাগুলো সরিয়ে দেবেন।
আল্লাহ বলবেন:
"فَكَشَفْنَا عَنكَ غِطَآءَكَ فَبَصَرُكَ ٱلْيَوْمَ حَدِيدٌ"
"আজ আমরা তোমার সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি, আর আজ তোমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে গেছে।"

নবীজীর ﷺ জন্য এই পর্দা আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি তখন একই সাথে দেখা পাচ্ছেন দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য জগতের। যেমন, তিনি ফেরেশতা দেখতে পান। আর ফেরেশতা দেখা কি এই চোখ দিয়ে সম্ভব? না। ওটা আধ্যাত্মিক চোখ দিয়ে সম্ভব। তাই কত সুন্দর করে আল্লাহ বললেন:
"مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَءَىٰ"
"হৃদয় মিথ্যা বলেনি সে যা দেখেছে।"
কারণ নবীজির ﷺ সেই দেখা ছিল একান্ত আধ্যাত্মিক অনুভবের মাধ্যমে একটি বাস্তব জগতের দর্শন। তার জন্য এটা কল্পনা নয়—এটা ছিল বাস্তব, স্পষ্ট বাস্তব।

এখন যদি এই দুইটি জগত—দৃশ্যমান ও অদৃশ্য—একসাথে মিশে যায়, আমি চাই আপনি এখন বুঝুন, কুরআন কত সুন্দরভাবে এর বিপরীতটা ব্যাখ্যা করেছে। বিপরীতটা কী?
যদি আল্লাহ কারো সামনে সেই পর্দা সরিয়েও দেন, তবুও তার হৃদয় বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে না পারে? কারণ সে তো শুরু থেকেই বিশ্বাসী ছিল না। তার হৃদয় সেই সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আপনি জানেন, যদি আপনি দীর্ঘদিন অস্বাস্থ্যকর খাবার খান, আর হঠাৎ করে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে শুরু করেন, তখন কী হয়?
আপনার পেট ব্যথা করে। কারণ শরীর স্বাস্থ্যকর জিনিসের প্রতি অভ্যস্ত নয়।
একইভাবে, যখন কেউ আধ্যাত্মিকভাবে দেউলিয়া হয়—আত্মিকভাবে দূরে চলে গেছে—আর হঠাৎ করে তার সামনে আধ্যাত্মিক বাস্তবতা উপস্থিত হয়, তখন কী হয় জানেন? সে একরকম অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। সে সেটা মেনে নিতে পারে না। আর নবী ﷺ যা দেখেছেন, তিনি সেটাকে গ্রহণ করেছেন। কেন? কারণ তাঁর হৃদয় ইতোমধ্যেই আত্মিকভাবে প্রস্তুত ছিল।
আপনি বুঝতে পারছেন তো?

এখন বিপরীত দিকটা দেখুন।


আল্লাহ কাফিরদের সম্পর্কে বলেন:
"وَلَوْ فَتَحْنَا عَلَيْهِم بَابًا مِّنَ ٱلسَّمَآءِ فَظَلُّوا۟ فِيهِ يَعْرُجُونَ"
"যদি আমরা তাদের জন্য আকাশ থেকে একটি দরজা খুলে দিই এবং তারা সেই দরজা দিয়ে ওপরে উঠতে শুরু করে,"
"لَقَالُوٓا۟ إِنَّمَا سُكِّرَتْ أَبْصَـٰرُنَا بَلْ نَحْنُ قَوْمٌۭ مَّسْحُورُونَ"
"তাহলে তারা বলত: আমাদের চোখে তো জাদু করা হয়েছে। আমরা তো নিছক মোহাচ্ছন্ন এক জাতি।"
তাহলে দেখলেন? তাদের সামনে অদৃশ্য জগৎ খুলেও দিলে, তারা অস্বীকারই করত। কারণ তাদের হৃদয় সেই জিনিস সহ্য করতে পারে না।

এখন কেউ যদি বলে, আমি কেন ফেরেশতাদের দেখি না? আমি কেন শয়তানকে দেখতে পারি না? আল্লাহর উত্তর কী?  "তুমি যদি দেখতেও, তবুও বিশ্বাস করতে না।" তুমি ভাবতে: "নাহ, কেউ বুঝি আমার পানিতে কিছু মিশিয়েছে!"
"আমি কোনো হ্যালুসিনেশন বা psychedelic experience-এ পড়েছি।"
"এটা শুধু আমার কল্পনা।"

আল্লাহ বলেন:
"وَلَوْ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ كِتَـٰبًا فِى قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوهُ بِأَيْدِيهِمْ لَقَالَ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ إِنْ هَـٰذَآ إِلَّا سِحْرٌۭ مُّبِينٌۭ"
"যদি আমরা তোমার উপর একটি কিতাব কাগজে লিখিত অবস্থায় অবতীর্ণ করতাম, এবং তারা নিজ হাতে সেই কাগজ স্পর্শ করত, তবুও যারা অবিশ্বাস করে তারা বলত: এটা তো স্পষ্ট জাদু!" তারা বলত: "বাহ, দারুণ জিনিস। কিন্তু জাদু!"

আবার ফিরে আসি সেই আয়াতে:
"مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ"
"হৃদয় মিথ্যা বলেনি, যা সে দেখেছে।"
দেখুন, এখানে আল্লাহ বলেননি 'his heart' (তার হৃদয়)। বরং বললেন 'the heart' (الْفُؤَاد)। এটা হলো لَامُ الْكَمَال, যার মানে হলো পূর্ণতার "লামের" ব্যবহার।
অর্থাৎ নবীজির ﷺ হৃদয় এতই পরিপূর্ণ ও নিখুঁত ছিল যে শুধুমাত্র সেই হৃদয়ই জিবরীল আঃ-কে সেভাবে দেখতে পারত। আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিই: আপনি কি সূর্যের দিকে সরাসরি তাকাতে পারেন? না। তাহলে কিভাবে আপনি নূরে গঠিত জিবরীল আঃ-কে তাকিয়ে থাকতে পারবেন? আর এটা শুধু নূর না—গায়বের নূর। এইরকম কিছু দেখার জন্য চাই বিশেষ শক্তি, এবং এই শক্তি আসে হৃদয় থেকে। আর সেই হৃদয় হলো নবীজির ﷺ হৃদয়। এইজন্য তাঁকে বলা হয়েছে "الفؤاد"। যেন সব হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ নবীজির ﷺ হৃদয়। এটা নবীজির ﷺ এক অসাধারণ প্রশংসা। মানুষ বলে: আমি নবীজিকে ﷺ প্রশংসা করতে চাই, আমি একটা নাশিদ লিখতে চাই। কিন্তু আপনি কুরআনের আয়াতগুলো পড়ুন— কুরআনের আয়াতের চেয়ে সুন্দর নাশিদ আপনি বানাতে পারবেন না। নবীজিকে ﷺ কুরআন যেভাবে বর্ণনা করে, আপনি তা ছুঁতেও পারবেন না। নবীজিকে ﷺ ভালোবাসতে চান? কুরআন পড়ুন। তাঁর অভিজ্ঞতা, যা তিনি দেখেছেন—তিনি তা সহ্য করতে পেরেছেন। তাঁর হৃদয় তাতে সক্ষম ছিল। সুবহানআল্লাহ।

এখন দেখুন, "what he saw"—সে কী দেখেছিল।
আরবিতে "رأى" শব্দের মানে শুধু "দেখা" না— আরেকটি মানে হচ্ছে "বোঝা" বা "অনুধাবন করা"। যেমন ইংরেজিতে আপনি বলেন: "I see." অথচ আপনি কিছু দেখেননি। আলো বন্ধ, আপনি কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন, তিনি বলছেন:
"এই হয়েছে, তারপর সেটা হয়েছে…" আপনি বলেন, "Oh, I see."
আসলে তো আপনি দেখেননি, আপনি বুঝেছেন। আরবিতেও একি জিনিস:
"رؤية" মানে শুধু দেখা না, মানে গভীরভাবে উপলব্ধি করাও।

 

এইজন্য আল্লাহ বলেন:
"أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ"
"তুমি কি দেখোনি, তোমার রব কীভাবে হাতি-অভিযানের লোকদের সাথে আচরণ করলেন?"
হাতির ঘটনা তো নবীজির ﷺ জন্মের আগেই ঘটেছিল। তাহলে তিনি দেখলেন কীভাবে?
আসলে এখানে "তুমি কি বোঝো না?" বা "তুমি কি উপলব্ধি করো না?" এই অর্থেই বলা হয়েছে।

তাই নবীজির ﷺ দেখা মানে শুধু দেখা না—তিনি সেটা গভীরভাবে অনুধাবন করেছেন।
যদি আর কেউ এই দৃশ্য দেখত, বলত, "আমি তো পাগল হয়ে গেছি। এটা স্বপ্ন, এটা হ্যালুসিনেশন!" কিন্তু নবীজি ﷺ তা দেখলেন এবং তিনি তা পুরোপুরি বুঝতে পারলেন।

আর তিনি ﷺ তা দেখলেন, এবং বুঝলেন—তিনি কী করতে এসেছেন।
তিনি ﷺ দেখলেন, এবং বুঝলেন—তাঁর দায়িত্ব কী। সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
তিনি বুঝলেন—তাঁকে যে অবস্থানে রাখা হয়েছে, সেটা কতটা ভারী।
তাঁর কাঁধে যে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেটা কেমন বোঝা। ভেবে দেখুন তো—মানব ইতিহাসে কোনো মানুষের উপর সবচেয়ে ভারী বোঝা কবে চাপানো হয়েছে? যে বোঝা স্বয়ং ফেরেশতাদের দলবল নিয়ে অবতরণ করতে হয়েছে, সেই বোঝা এখন একজন একক মানুষকে দেওয়া হচ্ছে!
এটা কেমন চাপ! কেমন শক্ত হৃদয় চাই এমন বোঝা বহন করতে? আর সেই হৃদয় হলো…
"مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ"
আল্লাহর রাসূল ﷺ এর হৃদয়।
যে কুরআনকে পাহাড় পর্যন্ত সহ্য করতে পারত না, সে কুরআন এই হৃদয় গ্রহণ করল।পাহাড় হলে ফেটে চৌচির হয়ে যেত, কিন্তু এই হৃদয়—না তো অস্বীকার করল, না ভয় পেল, না পিছিয়ে গেল। "كَذَبَ" এর অর্থের কথা মনে রাখুন—
না সে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজেছে, না সে দৌড়ে পালিয়েছে, না সে অস্বীকার করেছে।
আল্লাহু আকবার।

এরপর আল্লাহ বলেন:
"أَفَتُمَـٰرُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ"
"তোমরা কি তাকে নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছো, সে যা দেখে তা নিয়ে?"
আরবি ভাষায় সন্দেহ বোঝাতে ব্যবহৃত অনেক শব্দ আছে, যেমন:
شُبْهَة, شَكّ, مَرَج, لَبَس, رَيْب, مِرْيَة।
সবগুলোই বাংলা বা ইংরেজি অনুবাদে ‘সন্দেহ’ বা doubt বলে লেখা হয়।
তাহলে কি সব একই? না, সব আলাদা। প্রধান অর্থ হয়তো একই, কিন্তু গভীর, গৌণ অর্থে তারা ভিন্ন। এই আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হলো: "تُمَارُونَهُ" এর শিকড় শব্দ مِرْيَة। এর বিশেষ গৌণ অর্থ কী? কিছু যখন স্পষ্ট ও নির্মল ছিল, তুমি তাতে মিথ্যা, সংশয়, গুজব, বিকৃতি ঢুকিয়ে দিলে—
তাকে দূষিত করে দিলে, মানুষকে বিভ্রান্ত করালে, তখন তাকে বলে مِرْيَة। যেন পানি ছিল একদম পরিষ্কার, আর তুমি তাতে কাদামাটি ছুঁড়ে দিলা। এটাই তারা করছে নবী ﷺ যা দেখেছেন, তার সাথে। এবং এটা হয়তো ব্যাখ্যা করে "Satanic Verses" সম্পর্কিত মিথ্যাচার। তারা স্পষ্ট কিছু শুনল, তাতে কাদা ছুঁড়ে দিল, আর আল্লাহ আগেই বলছেন:
"Are you going to corrupt what he sees?" পূর্বের আয়াতে বলা হয়েছিল:
"مَا كَذَبَ ٱلْفُؤَادُ مَا رَأَىٰ" "হৃদয় মিথ্যা বলেনি, যা সে দেখেছে।" এখানে ছিল —যা সে দেখেছে। আর এখন বলা হচ্ছে: "أَفَتُمَـٰرُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ" "তোমরা কি বিতর্কে যাচ্ছো তার দেখা নিয়ে?" এই আয়াতে বলা হচ্ছে "يَرَىٰ"—সে যা দেখে (বর্তমানকাল)।
এর মানে কি শুধু সে যা চোখে দেখে? না—এখানে বোঝানো হচ্ছে তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার উপলব্ধি, তার তাওযীফ। তিনি যা দেখেন—আলোকে দেখেন, হককে দেখেন, তিনি বাস্তবতাকে যেমন দেখেন, তোমরা কি সেই উপলব্ধিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যাচ্ছ? তিনি যেভাবে তোমাদের মিথ্যা ধর্মকে চিরে ফেলেন, তোমাদের অজুহাতগুলোকে কাটিয়ে দেন, তোমরা কি সেটা নিয়ে সন্দেহ করো?

এইটাই হওয়া উচিত আমাদের মনোভাব। যখন কেউ ধর্ম নিয়ে সন্দেহ ছুঁড়ে দেয়, এই আয়াত মনে পড়া উচিত:
"أَفَتُمَـٰرُونَهُ عَلَىٰ مَا يَرَىٰ"
"তোমরা সন্দেহ করবে তাঁকে নিয়ে, যা তিনি দেখেন?"

আল্লাহর রাসূল ﷺ এর দৃষ্টিভঙ্গি, উপলব্ধি, এই কুরআনের চোখে দেখা বাস্তবতা এত স্পষ্ট, এত নির্মল— তাতে সন্দেহ করবে কীভাবে? এটাই কাফিরদের ষড়যন্ত্র—واضح সত্যকে কাদাযুক্ত করে দেয়া। তারা একটিমাত্র ইস্যু নেয়, তা নিয়ে মোচড়ায়, চাপ দেয়: “এটাই ধরে চেপে ধরে।
কুরআন, ওহী—সবকিছুর সত্যতা তাতে মুছে দিতে চায়। একটা তুচ্ছ অভিযোগে পুরো ইসলাম নাকি প্রশ্নবিদ্ধ! এমনকি তারা "Satanic verses" ধরে বসে— "উহ, তিনি হয়তো লাত-মানাত-উজ্জা ভালোবাসতেন!" তারা এরকম কাদাযুক্ত করবে—তবে সত্য তো রয়ে যায়। এইসব ইনফ্লুয়েন্সড TikTok ভিডিও আর অজ্ঞান সোশ্যাল মিডিয়া বক্তা— তারা কুরআনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের ভুল যুক্তি disproven করে, তাতেই যেন ইসলাম disproven হয়ে গেল! এটাই আজকের তরুণদের সমস্যা— নিজেদের ধর্ম শেখে না, কুরআন বোঝে না। তাই এইসব মিথ্যা অপব্যাখ্যায় সন্দেহে পড়ে যায়। সত্য কী করে জানবে? কুরআনের সাথে বসো। এই কুরআন তোমাকে শক্তিশালী বানাবে। তোমার সন্দেহ ভেঙে চুরমার করে দেবে। তোমাকে অচল নয়—অপরাজেয় বানাবে। মিরাজের ঘটনা যখন কুরাইশ শুনল, তারা বলল: "তুমি কি বলছ, তুমি উড়তে পারো? আকাশ ভ্রমণ করো?" তাদের কথা শুনে মুসলিমও যেন পিছিয়ে যায়:
"না, মানে… এটা তো হয়তো স্বপ্ন ছিল, মানসিক ভ্রমণ ছিল…" না ভাই। এটা ছিল বাস্তব ভ্রমণ। এই ভ্রমণ ঘটেছে। এটা আলো থেকে আলোর দিকে। এটা অদৃশ্য জগতের বাস্তব দৃষ্টির মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে।

"رَأَىٰ، يَرَىٰ، مَا زَاغَ الْبَصَرُ، مَا كَذَبَ الْفُؤَادُ"—
দেখেছে, দেখছে, বিচ্যুতি হয়নি, হৃদয় মিথ্যা বলেনি—সব বাস্তব ভাষা।

এইসব কথাকে লঘু করে দিবে? মানসিক ব্যাখ্যা দিয়ে হালকা করে দিবে? না, এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বাস্তব সফর। কাল আমরা মিরাজ নিয়ে আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ। সেটা আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন সেশন হতে যাচ্ছে। দোয়া করবেন, যেন আমি যথাযথভাবে সেটা উপস্থাপন করতে পারি।