আইন লাম মীম (ع ل م)

Spread the love

আচ্ছা, কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কুরআনের কিছু শব্দ কতটা জাদুকরী হতে পারে? আজ আমরা তেমনই তিনটি অক্ষর নিয়ে একটা গল্প শুনব: ع (আইন), ل (লাম), আর م (মীম)। এই তিনটি অক্ষর একসাথে মিলে যে শব্দগুলো তৈরি করে, তা আমাদের চিন্তার জগৎটাকেই বদলে দিতে পারে।

ধরুন, আমরা একটা শব্দ নিলাম: عِلْمٌ (ইলম)। আমরা সবাই জানি, এর মানে হলো জ্ঞান। কিন্তু কুরআনের ভাষায় ‘ইলম’ শুধু সাধারণ জ্ঞান নয়। এটা হলো এমন জানা, যা একেবারে পাকা, যাতে কোনো ভুল নেই। এমনভাবে কোনো কিছুকে চেনা, যেন তার ভেতর-বাহির সব আপনার কাছে পরিষ্কার।

এই মূল থেকে আরও দুটি সুন্দর শব্দ আসে: একজন হলেন عَالِمٌ (আলিম), মানে যিনি জানেন। আর আরেকজন হলেন عَلِیْمٌ (আলীম), মানে যিনি খুব গভীরভাবে জানেন, যার জ্ঞান একেবারে নিখুঁত। আল্লাহ হলেন عَلِیْمٌ (আলীম)

প্রাচীন আরবরা বলতেন, এই অক্ষরগুলোর আসল মানে হলো ‘চিহ্ন’। এমন একটা চিহ্ন, যা একটা জিনিসকে অন্য সব কিছু থেকে আলাদা করে চেনায়। ঠিক যেমন একটা পতাকা একটা দেশকে চেনায়, বা রাস্তার পাশের একটা মাইলফলক আমাদের পথ দেখায়। জ্ঞানও তো ঠিক তেমনই, তাই না? যা সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করে দেয়।

আরবদের কাছে ‘ইলম’ আর সাধারণ ‘জানা’র মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। ধরুন, আপনি একটা রাস্তা ভুলে গিয়েছিলেন, অনেকদিন পর সেখানে গিয়ে আবার চিনতে পারলেন। এটাকে আরবরা বলতো مَعْرِفَۃٌ (মা’রিফাহ) বা ‘পুনরায় চেনা’। কিন্তু عِلْمٌ (ইলম) হলো এমন জ্ঞান, যা কখনও পুরোনো হয় না, যা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এটা হলো সেই জ্ঞান, যা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে আসে, ওহীর মাধ্যমে। এটা মানুষের বানানো কোনো ধারণা বা আবেগ নয়, যাকে আমরা আজকাল বলি ‘আমার মনে হচ্ছে’ বা ‘আমার যা ভালো লাগে’। কুরআন বলে, তোমার আবেগ এক জিনিস, আর সত্যিকারের জ্ঞান বা ‘ইলম’ আরেক জিনিস।

আর এই ‘ইলম’ বা জ্ঞানের সবচেয়ে বড় চিহ্ন কী, জানেন?

এই ع ل م থেকেই আরেকটি অসাধারণ শব্দ এসেছে: عَالَمٌ (আলাম), যার বহুবচন হলো عَالَمِیْنَ (আলামীন)। আমরা এর অনুবাদ করি ‘জগৎ’ বা ‘বিশ্ব’। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা আরও সুন্দর।

শব্দটা এসেছে عَلَمٌ (আলাম) থেকে, যার মানে হলো ‘চিহ্ন’ বা ‘পতাকা’। তাহলে عَالَمٌ (আলাম) মানে কী দাঁড়ালো? এর মানে হলো—এমন কিছু, যার মাধ্যমে অন্য কিছুকে চেনা যায়।

সুবহানাল্লাহ! এবার ভাবুন তো, এই পুরো বিশ্ব, এই আকাশ, এই তারা, এই গাছপালা, এই পাহাড়-নদী—এগুলো সবই তো এক-একটা চিহ্ন, তাই না? কার চিহ্ন? যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, সেই মহান আল্লাহর চিহ্ন। আমরা এই সৃষ্টিজগতকে দেখেই তো স্রষ্টাকে চিনি, তাঁর ক্ষমতাকে বুঝি। তাই এই পুরো বিশ্বটাই হলো একটা عَالَمٌ (আলাম), আল্লাহর পরিচয়ের এক বিশাল প্রদর্শনী।

এজন্যই তো আমরা বলি, رَبّ الْعَالَمِیْنَ (রাব্বুল আলামীন), অর্থাৎ—‘সকল জগতের প্রতিপালক’। এর মানে শুধু পৃথিবীর রব নন, তিনি মহাবিশ্বের প্রতিটি কোণার, প্রতিটি সৃষ্টির, প্রতিটি চিহ্নের রব। তিনি সেই রব, যিনি তাঁর এই চিহ্নগুলোর মাধ্যমে আমাদের কাছে নিজেকে পরিচিত করান।

এবার আসি আরেকটা মজার বিষয়ে। কুরআন বলছে, আল্লাহ আদমকে (আ.) সবকিছু শিখিয়েছেন—عَلَّمَ اَدَمَ (আল্লামা আদামা)। তিনি মানুষকে কলম দিয়ে শিখিয়েছেন, কথা বলতে শিখিয়েছেন। এর মানে কি এই যে, আল্লাহ আমাদের স্কুলে টিচারের মতো হাতে ধরে সব শিখিয়ে দেন?

না! বরং এর মানে আরও গভীর। আল্লাহ আমাদের সরাসরি সবকিছু শিখিয়ে দেন না, বরং শেখার ক্ষমতাটা আমাদের ভেতরে দিয়ে দিয়েছেন। ঠিক যেমন, আল্লাহ আমাদের শিকারী কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেন না, কিন্তু তিনি আমাদের বুদ্ধি দিয়েছেন, যার মাধ্যমে আমরা কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার উপায় বের করতে পারি। তিনি আমাদের ভেতরে একটা সুপার কম্পিউটার বসিয়ে দিয়েছেন, যা দিয়ে আমরা নিজেরাই শিখতে পারি, আবিষ্কার করতে পারি। এটাই আল্লাহর সবচেয়ে বড় দান।

তাহলে জ্ঞান দুই প্রকারের হলো। এক প্রকার হলো ওহীর জ্ঞান, যা আল্লাহ শুধু নবীদের দেন। আর দ্বিতীয় প্রকার হলো সেই ক্ষমতা, যা আল্লাহ আমাদের সবাইকে দিয়েছেন। চেষ্টা করলে আমরা সবাই সেই জ্ঞান অর্জন করতে পারি।

গল্পের শেষে, কুরআনের সবচেয়ে সুন্দর একটি আয়াতে আসি। সূরা ফাতিরে আল্লাহ বলছেন:

“তুমি কি দেখো না, আমি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামাই, আর তা দিয়ে নানা রঙের ফল বের করে আনি? পাহাড়ের মধ্যেও আছে সাদা, লাল, কালো বিচিত্র সব রেখা। আর এভাবেই মানুষ, জীবজন্তু—সবার মধ্যেই কত ভিন্নতা!”

এই কথাগুলো বলার পর আল্লাহ কী বলছেন জানেন?

তিনি বলছেন, “আমার বান্দাদের মধ্যে কেবল তারাই আমাকে সত্যিকার অর্থে ভয় করে, যাদের জ্ঞান আছে—অর্থাৎ ‘উলামা’রা।” (সূরা ফাতির: ২৮)

এখানে ‘উলামা’ কারা? যারা শুধু ধর্মীয় বই পড়েন, তারা? না! কুরআন এখানে ‘উলামা’ বলতে সেই বিজ্ঞানীদের কথা বলছে, সেই গবেষকদের কথা বলছে, যারা এই আকাশ, বৃষ্টি, ফল, পাহাড় আর জীবজন্তুদের নিয়ে গবেষণা করে। কারণ, তারাই আল্লাহর সৃষ্টিকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখে আর অবাক হয়ে বলে, “সুবহানাল্লাহ! কী অসাধারণ এক স্রষ্টা!” তারাই আল্লাহর ক্ষমতাকে সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারে, আর তাই তাদের অন্তর ভয়ে আর শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে।

তাহলে দেখুন, কুরআন জ্ঞানকে কতটা মর্যাদা দিয়েছে! আল্লাহর সৃষ্টিকে জানা, বিজ্ঞানকে জানা—এটাও আল্লাহর কাছাকাছি যাওয়ার একটা পথ। এটাই হলো ع ل م এর আসল জাদু।